ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ পরকালীন জবাবদিহিতা সহজ করে || -ড. মো: হাবিবুর রহমান
"ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ পরকালীন জবাবদিহিতা সহজ করে"
-ড. মো: হাবিবুর রহমান
হযরত ওমর রা: বলেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসেব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসেব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসেব গৃহীত হবার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসেব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।‘
ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি সে, যে দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে দুনিয়া তাকে পরিত্যাগ করার পূর্বেই। কবরকে আলোকিত করে কবরে বসবাস করার পূর্বেই। স্বীয় প্রভুকে সন্তুষ্ট করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভের পূর্বেই। জামায়াতে সালাত আদায় করে তার ওপর জামায়াতে সালাত (অর্থাৎ জানাযার সালাত) পঠিত হবার পূর্বেই। নিজের হিসেব নিজেই গ্রহণ করে হিসেব দিবসে তার হিসেব গ্রহণ করার পূর্বেই।’
আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের জীবন পরিচালনার পদ্ধতি ও পন্থা কী হবে তাও বলে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে,
قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (৩৮)
আমি বললাম, ‘তোমরা সবাই তা থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোনো হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (সূরা বাকারা : ৩৮)
উপরোক্ত আয়াতে যে জীবন-বিধানের কথা বলা হয়েছে মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহর এই বিধানের চেয়ে উত্তম বিধান আর নেই। তাই এই বিধান যারা দুনিয়ায় মেনে চলবে তারা পরকালীন জীবনে শান্তিতে থাকবে এবং যারা এটা মানবে না তারা কঠিন কষ্টের মধ্যে নিমজ্জিত হবে।
কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই আল্লাহ একাকী তাঁর সামনে দাঁড় করাবেন এবং তার কাছ থেকে দুনিয়ার জীবনের প্রত্যেকটি কাজের হিসাব নিবেন। এ ব্যাপারে সূরা মরিয়মে আল্লাহ বলেন,
وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْدًا (৯৫)
“আর কিয়ামতের দিন তাদের সকলেই তাঁর কাছে আসবে একাকী।” (সূরা মরিয়ম : ৯৫)
উপরোক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায়, আল্লাহর কাছে উপস্থিত হয়ে সকলকে তার জীবনের সকল কাজের হিসাব দিতে হবে। বিশেষ করে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে থেকে তার জীবন, যৌবন এবং সম্পদের হিসাব নিবেন। এ ব্যাপারে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
لَا تَزُولُ قَدَمُ ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَسْأَلَهُ عَنْ خَمْسٍ : عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ ، وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَا أَنْفَقَهُ ، وَمَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ
“পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামতের দিন প্রভুর নিকট থেকে আদম সন্তানের পা সরবে না। জিজ্ঞাসা করা হবে তার বয়স সম্পর্কে, কী কাজে সে তা অতিবাহিত করেছে, তার যৌবন সম্পর্কে কী কাজে সে তা বিনাশ করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে সে তা অর্জন করেছে আর কী কাজে সে তা ব্যয় করেছে এবং সে যা শিখেছিল তদনুযায়ী কী আমল সে করেছে?” (তিরমিযি)
যারা দুনিয়ায় ভালো কাজ করে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, তাদের ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে, কেবল তারাই খুব সহজেই তাদের আমলনামা পেশ করতে পারবে। আর যারা দুনিয়ায় নিজের বিবেক দিয়ে কুরআনকে অনুধাবন করবে না, কুরআনের বিধান মানবে না আখেরাতে সে অন্ধ হয়ে উঠবে, এরাই আসলে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ فَمَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَأُولَئِكَ يَقْرَءُونَ كِتَابَهُمْ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا (৭১) وَمَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلًا (৭২)
“স্মরণ কর, যেদিন আমি প্রত্যেক মানুষকে তাদের ইমামসহ ডাকব। অতঃপর যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তারা নিজেদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণ অবিচার করা হবে না। আর যে ব্যক্তি এখানে অন্ধ সে আখিরাতেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট।”
(সূরা বনি ইসরাইল : ৭১-৭২)
আখেরাতে দুনিয়ার জীবনের আমলের হিসাব গ্রহণের জন্য অন্য কারো সাক্ষ্য প্রয়োজন হবে না বরং সে নিজের মুখেই নিজের আমলনামা পাঠ করবে, এটাই তার হিসাবের জন্য যথেষ্ট হবে। আল্লাহ সকল মানুষকেই তার আমলনামা পাঠ করার জন্য বলবেন এবং মানুষ নিজেই তার নিজের আমলনামা আল্লাহর কাছে পেশ করবে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا (১৪)
“পাঠ কর তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশকারী হিসেবে যথেষ্ট।” (সূরা বনি ইসরাইল : ১৪)
যদি কেউ নিজের আমলনামা পেশ করতে ইচ্ছুক না হয় তখন তার মুখে মোহর করে দেয়া হবে তখন তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার দুনিয়ার জীবনের অন্যায় কাজের সাক্ষ্য দিতে থাকবে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে,
الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (৬৫)
“আজ আমি তাদের মুখে মোহর মেরে দেবো এবং তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে ও তাদের পা সে সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে যা তারা অর্জন করত।” (সূরা ইয়াসিন : ৬৫)
দুনিয়ার জীবনের হিসাব আখেরাতে এমন সূক্ষ্ম হবে যে, মানুষ দুনিয়ায় কী করেছিলো, কী বলেছিলো এবং কী কল্পনা করেছিলো যা তার জীবনে কাজে পরিণত করেনি সেটাও আল্লাহ সেদিন মানুষের সামনে প্রকাশ করে দিবেন। তখন মানুষ আফসোস করতে থাকবে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا (৪৯)
“আর তারা বলবে, ‘হায় ধ্বংস আমাদের! কী হল এ কিতাবের! তা ছোট-বড় কিছুই ছাড়ে না, শুধু সংরক্ষণ করে’ এবং তারা যা করেছে, তা হাজির পাবে। আর তোমার রব কারো প্রতি জুলুম করেন না।” (সূরা কাহাফ : ৪৯)
দুনিয়ায় যারা অপরাধ করবে এবং অপরাধমূলক কাজের প্রেরণা দেবে, তাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা অপরাধ করবে এসকল ব্যক্তির অপরাধের বুঝাও কিয়ামতে অন্যায় কাজের উদ্বুদ্ধকারীর ঘাড়ে আল্লাহ চাপিয়ে দিবেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِلِقَاءِ اللَّهِ حَتَّى إِذَا جَاءَتْهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً قَالُوا يَا حَسْرَتَنَا عَلَى مَا فَرَّطْنَا فِيهَا وَهُمْ يَحْمِلُونَ أَوْزَارَهُمْ عَلَى ظُهُورِهِمْ أَلَا سَاءَ مَا يَزِرُونَ (৩১)
“যারা আল্লাহর সাক্ষাৎ অস্বীকার করেছে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমনকি যখন হঠাৎ তাদের কাছে কিয়ামত এসে যাবে, তারা বলবে, ‘হায় আফসোস! সেখানে আমরা যে ত্রুটি করেছি তার ওপর।’ তারা তাদের পাপের বোঝাসমূহ তাদের পিঠে বহন করবে; সাবধান! তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট!
(সূরা আনআম : ৩১)
এসকল হিসাবকার্য পরচিালনা করার জন্য আল্লাহর অন্য কারো সহযোগিতার প্রয়োজন হবে না বরং তিনি নিজেই যথেষ্ট। তিনি যখন কোনোকিছু করতে চান শুধু হও বললেই সেটা হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,
إِنَّمَا قَوْلُنَا لِشَيْءٍ إِذَا أَرَدْنَاهُ أَنْ نَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (৪০)
“যখন আমি কোনোকিছু ইচ্ছা করি, তখন আমার কথা শুধু কেবল এই বলা যে, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।” (সূরা নাহল : ৪০)
এ ছাড়া মানুষের হিসাব সংরক্ষণের জন্য আল্লাহর সুনিপুণ দৃষ্টি ফেরেশতারা নিয়োজিত রয়েছে। যাদের সংখ্যা গণনা করা সম্ভব নয়। যারা আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো কথায় পরিচালিত হয় না। এসকল ফেরেশতাদের দিয়ে প্রত্যেক মানুষের আমলনামা আল্লাহ সংরক্ষণ করছেন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ (১৭) مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ (১৮)
যখন ডানে ও বামে বসা দু’জন লিপিবদ্ধকারী পরস্পর গ্রহণ করবে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে।” (সূরা কাফ : ১৭-১৮)
এ সম্পর্কে সূরা ইনফিতারে আল্লাহ বলেন,
وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ (১০) كِرَامًا كَاتِبِينَ (১১) يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ (১২)
“আর নিশ্চয় তোমাদের উপর সংরক্ষকগণ রয়েছে। সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তারা জানে, যা তোমরা কর।”
(সূরা ইনফিতার : ১০-১২)
আল্লাহর ক্ষমতা এত বেশি যে, যদি আল্লাহ চান ফেরেশতাদের ছাড়াও এসকল কাজ করবেন সেটাও আল্লাহ করতে পারেন। কারণ আল্লাহ মানুষের এত নিকটে আছে যে, মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। আল্লাহ মানুষের অন্তরের সকল খবর রাখেন এবং মানুষের সকল কাজের সাথে থাকেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ (১৬)
“আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি। আর আমি তার গলার ধমনী হতেও অধিক কাছে।” (সূরা ক্বাফ : ১৬)
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার বুঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জীনের দুনিয়ার সকল কাজের হিসাব সংরক্ষণ করছেন এবং কিয়ামতের দিনে সেটা ফাঁস করে দিবেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
يَوْمَ تُبْلَى السَّرَائِرُ (৯) فَمَا لَهُ مِنْ قُوَّةٍ وَلَا نَاصِرٍ (১০)
যে দিন গোপন বিষয়াদি ফাঁস করা হবে। অতএব তার কোন শক্তি থাকবে না। আর সাহায্যকারীও না। (সূরা তারিক : ৯-১০)
আল-কুরআনে আরো বলা হয়েছে,
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا (৪)
সেদিন জমিন তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (সূরা যিলযাল : ৪)
উপরোল্লিখিত আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক বান্দাহর দুনিয়ার জীবনের সকল কর্মকা- আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ থাকছে এবং কিয়ামতের দিন বান্দাহর সামনে সেটা ফাঁস করা হবে। তখন অপরাধীদের চেহারা মলিন হবে তারা লজ্জিত-অপমানিত হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহ বলেন,
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ خَاشِعَةٌ (২) عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ (৩) تَصْلَى نَارًا حَامِيَةً (৪) تُسْقَى مِنْ عَيْنٍ آنِيَةٍ (৫) لَيْسَ لَهُمْ طَعَامٌ إِلَّا مِنْ ضَرِيعٍ (৬) لَا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِي مِنْ جُوعٍ (৭)
“সেদিন অনেক চেহারা হবে ভীতসন্ত্রস্ত। কর্মক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত আগুনে। তাদের পান করানো হবে ফুটন্ত ঝর্ণা থেকে। তাদের জন্য কাঁটাবিশিষ্ট গুল্ম ছাড়া কোনো খাদ্য থাকবে না। তা মোটা-তাজাও করবে না এবং ক্ষুধাও নিবারণ করবে না। (সূরা গাশিয়াহ : ২-৭)
উপরোক্ত কুরআন-হাদীসের বক্তব্য অনুসারে একজন মুমিনের দুনিয়ায় থাকতেই আখেরাতের হিসাব দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে জীবনের সকল কাজকর্ম পরিচালনা করা দরকার। আমি যদি দুনিয়ায় থাকতেই আখেরাতের হিসাব সহজ করার জন্য নিজের জীবনের সকল আমল সংরক্ষণ করার চেষ্টা করি, নিজে আত্মসমালোচনা করে ভালোটা গ্রহণ করি খারাপটা বর্জন করি তাহলে আখেরাতের হিসাবটা সহজ হবে। এ জন্য ইসলামী সংগঠনের মধ্যে প্রত্যেক কর্মী ও দায়িত্বশীলের জন্য নিজের রিপোর্ট সংরক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছে। এই রিপোর্ট একজন মুমিনের জন্য পরকালীন জীবনের আয়নাস্বরূপ। আয়নায় যেমন নিজের চেহারা দেখা যায় ঠিক তেমনি নিজের ব্যক্তিগত রিপোর্টের মাধ্যমে পরকালীন জবাবদিহিতা কেমন হবে সেটা অনুধাবন করা যায়। এ জন্য প্রত্যেক মুমিনের উচিত ব্যক্তিগত রিপোর্ট সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা।
মানুষ পরকালীন হিসাবের চিন্তা ভুলে দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্যময় মরীচিকার পিছনে ছুটছে যেটা খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং নগণ্য। এটা একটা ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই না। এই মরীচিকাময় দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের পথে তারাই ছুটতে পারে যারা পরকালীন জীবনের হিসাব ও জবাবদিহিতার বিষয়ে গাফেল। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (২০)
“তোমরা জেনে রাখ! দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা, শোভা-সৌন্দর্য, পারস্পরিক গর্ব-অহঙ্কার আর ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা মাত্র। তার উদাহরণ হলো- বৃষ্টি; আর তা থেকে উৎপন্ন শস্যাদি। (যা) কৃষকের মনকে আনন্দে ভরে দেয়; তারপর তা পেকে যায়; তখন তুমি তাকে হলুদ বর্ণ দেখতে পাও, পরে তা খড়-ভুসি হয়ে যায়। (আর আখেরাতের চিত্র অন্যরকম, পাপাচারীদের জন্য), আখেরাতে আছে কঠিন শাস্তি, (আর নেককারদের জন্য আছে) আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার বস্তু ছাড়া আর কিছুই না।” (সূরা হাদিদ : ২০)
অন্যায় থেকে ফিরে থাকা এবং সঠিক পথের অনুসারী হওয়া ঈমানের একান্ত দাবি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারী-পুরুষের জন্য এমন কিছু চিন্তা-উপলব্ধি রয়েছে, যা মানুষকে অন্যায় পথ থেকে দূরে রাখে। সঠিক পথের সন্ধান দেয়। এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহর একত্ববাদের দিকে রুজু হওয়া এবং আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার জন্য আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়া। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে ডেকে ডেকে সে কথাই বলেছেন,
سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (২১)
“তোমরা এগিয়ে যাও তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্য, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের প্রশস্ততার মতো। তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে তাদের জন্য; যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা করেন, তা দেন। আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল।” (সূরা হাদিদ : ২১)
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী কখন কার জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে সেটা কউ জানে না, তাই এখন থেকেই পরকালীন জীবনের হিসাব সহজ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। সর্বোপরি আল্লাহর ইবাদতে সময় দিতে হবে। আল্লাহ সকল বনি আদমকে ডেকে বলেন,
يَا ابْنَ آدَمَ تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِي ، أَمْلَأْ صَدْرَكَ غِنًى ، وَأَسُدَّ فَقْرَكَ ، وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ ، مَلَأْتُ صَدْرَكَ شُغْلاً ، وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ
আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদাতের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা কর, আমি তোমার অন্তরকে ঐশ্বর্যে পূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব দূর করে দিব। তুমি তা না করলে আমি তোমার দুই হাত কর্মব্যস্ততায় পরিপূর্ণ করে দিব এবং তোমার অভাব-অনটন রহিত করবো না। (তিরমিজি) লেখক : গবেষক ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
আলোচনা নোট || আমাদের ব্যক্তিগত রিপোর্ট
* রিপোট: সুষ্ঠ পরিকল্পনা ভিত্তিক একটি কাজের বাস্তবায়িত অংশের প্রতিবেদনকে রিপোর্ট বলে।
*ব্যক্তিগত রিপোর্ট: ব্যক্তিগত রিপোর্ট হল- কোন ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজের প্রতিবেদন বা খতিয়ান।
*ভারসাম্যপূর্ণ জীবন: পরিকল্পিত জীবন পরিচালনা ও নিজেকে গড়ে তোলার নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।
* ব্যক্তিগত রিপোর্টের দিকসমূহঃ
ক. ব্যক্তিগত মানোন্নয়নের কাজ
খ. সাংগঠনিক কাজ
গ. ব্যক্তিগত মানোন্নয়নের অবশিষ্ট কাজ।
ক. ব্যক্তিগত মানোন্নয়নের কাজ:
১) কুরআন অধ্যয়ন: জ্ঞানের মূল উৎস ও উত্তম জীবন গঠনে সহায়ক।
অধ্যয়নের পদ্ধতিঃ
i) সহীহ তেলাওয়াত
ii) সরল অর্থ জানা
iii) ব্যাখ্যা
iv) শিক্ষা
২) হাদীস অধ্যয়ন: জ্ঞানের দ্বিতীয় উৎস ও রাসুল (সঃ) এর জীবন পদ্ধতি।
অধ্যয়নের পদ্ধতিঃ
i) সরল অর্থ জানা
ii) ব্যাখ্যা
iii) শিক্ষা
৩) ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন-
পদ্ধতিঃ
i) মনোযোগ সহকারে পড়া
ii) ধারাবাহিকভাবে পড়া
iii) নির্ধারিত বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা করা।
৪) পাঠ্য পুস্তক অধ্যয়ন:
প্রয়োজনীয়তা- ভাল ছাত্র হিসেবে গড়ে উঠা আন্দোলনের দাবী।
পদ্ধতি-
i) সুন্দর পরিকল্পনা থাকা
ii) নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হওয়া
iii) নিয়মিত অধ্যয়ন করা
iv) নোট করা।
৫) নামায আদায় করাঃ
আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের সর্বোত্তম পন্থা। জামায়াতের সাথে নামায পড়াকে ইকামাতে সালাত বলে। সালাত মু'মিন জীবনের মি'রাজ। সালাত মু'মিন জীবনকে সুশৃংখলভাবে গড়ে তোলে।
খ. সাংগঠনিক কাজ:
৬) কর্মী যোগাযোগ:
গুরুত্বঃ
i) একে অন্যকে জানা
ii) ভুল বুঝাবুঝি দূর করা
iii)পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর করে।
পদ্ধতি:
i) পরিকল্পনা গ্রহণ
ii) স্থান ও সময় নির্ধারণ
iii) ঐকান্তিকতা
iv) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অবস্থা জানা
ⅴ) সাংগঠনিক আলোচনা
vi) সার্বিক আন্দোলনের আলোচনা
vii) এহতেসাব
৭) বন্ধু সমর্থক যোগাযোগ ও বই বিতরণ:
i) বন্ধু যোগাযোগ হবে দাওয়াতী কাজের জন্য
ii) কমপক্ষে ৩ জন বন্ধু টার্গেট নিতে হবে
iii) মনমানসিকতা বুঝে বই পড়তে দেয়া।
৮) সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন:
i) প্রতিদিন নিয়মিত কিছু সময় দাওয়াতী কাজ করা
ii) সমর্থকদের রিপোর্ট দেয়া
iii) কিশোরকণ্ঠ বিতরণ করা ইত্যাদি।
vi) বৈঠকে উপস্থিত হওয়া
গ. ব্যক্তিগত মানোন্নয়নের অবশিষ্ট কাজ:
৯) পত্র-পত্রিকা পাঠ: নিজ দেশের ও চলমান বিশ্বের খবর জানা।
১০) শরীর চর্চা: শরীর চর্চা নিয়মিত করতে হবে।
১১) আত্ম সমালোচনা:
প্রয়োজনীয়তা-
১. আত্মসমালোচনার কারণে অহঙ্কার সৃষ্টি হয়না
২. নিজের ত্রুটি নিজেই সংশোধন করতে পারে।
তাওবার নিয়ম:
i) সর্ব প্রথম নিজের ভুলের স্বীকৃতি
ii) আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া
iii) দ্বিতীয়বার এ ধরনের ভুল না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া
iv) ভাল কাজের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা
v) ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া।
রিপোর্ট আমাদের যা শিখায়:
i) আত্মশুদ্ধি
ii) ভুল সংশোধন
iii) শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা
iv) উন্নত আমল
v) আখেরাতের জবাবদিহীর অনুভূতি
vi) নিজেকে ভাল ছাত্র হিসেবে গড়ে তোলা।
No comments