দারসুল কোরআন সুরা আলাক (১-৫)
দারসুল কোরআনসুরা আলাক (১-৫)
★আরবী ইবারত:-
★বাংলা অনুবাদ:-
★সুরা পরিচিতি:-
আল আলাক্ব (আরবি ভাষায়: العلق) কুরআনের ৯৬ তম সূরা। সূরা আলাক্বের আয়াত সংখ্যা ১৯। এতে একটি রূকু ও একটি সিজদাহ রয়েছে। আলাকের পূর্ববর্তী সূরা সূরা ত্বীন এবং পরবর্তী সূরা সূরা ক্বদর। এ সুরায় ৭২ টি শব্দ এবং ২৮১ টি বর্ণ রয়েছে।
★নামকরণ:-
আল আলাক্ব (আরবি ভাষায়: العلق) শব্দের অর্থ হলো- ঝুলে থাকা বস্তু,জোকের ন্যায় বস্তু,জমাট বাধা রক্ত। সূরাটির দ্বিতীয় আয়াতে (خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ) উল্লেখিত আলাক (علق) শব্দ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
★বিষয়বস্ত্ত:-
সূরাটিতে চারটি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
★নাযিলের সময়কাল:-
সূরা আলাক্ব মক্কায় অবতীর্ণ। এটি মক্কী সূরা হিসাবে পরিগণিত।
এই সূরাটির দুটি অংশ পরিলক্ষ্য করা যায়। প্রথম অংশটি প্রথম আয়াত থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম আয়াত অবধি বিস্তৃত। অত:পর দ্বিতীয় অংশটি ষষ্ট আয়াত থেকে শুরু হয়ে সূরার শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯শ আয়াত অবধি বিস্তৃত। প্রথম অংশটি যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অবতীর্ণ সর্বপ্রথম অহী এ ব্যাপারে উম্মাতে মুসলিমার আলেম সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একমত। এ প্রসংগে ইমাম আহমাদ, বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ অসংখ্য সনদের মাধ্যমে হযরত আয়েশা (রা:) থেকে যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তা সর্বাধিক সহীহ হাদীস হিসেবে গণ্য । এ হাদীসে হযরত আয়েশা (রা:) নিজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ওহী শুরু হবার সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও ইবনে আব্বাস (রা:),আবু মূসা আশ’আরী (রা:) ও সাহাবীগণের একটি দলও একথা বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর সর্বপ্রথম কুরআনের এই আয়াতগুলোই নাযিল হয়েছিল । আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হারাম শরীফে নামায পড়া শুরু করেন এবং আবু জেহেল তাকে হুমকি দিয়ে তা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে তখন দ্বিতীয় অংশটি নাযিল হয়।
★গুরুত্ব :-
ক্বদরের পবিত্র রজনীতে হেরা গুহায় বান্দার প্রতি আল্লাহর সবচাইতে বড় অনুগ্রহ নুযূলে কুরআনের শুভ সূচনা হয় অত্র সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াতের মাধ্যমে। যদিও কুরআন সংকলনকালে আল্লাহর হুকুমে এ পাঁচটি আয়াতকে ৯৬নং সূরার শুরুতে যুক্ত করা হয়েছে। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে একত্রে সূরা ফাতেহাই সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়।[1]
★নুযূলে অহি-র বিবরণ :-
নুযূলে অহি-র বছরে রবীউল আউয়াল মাস থেকে রাসূল (সা:) সত্যস্বপ্ন দেখতে থাকেন। ছ’মাস পর রামাযান মাসে তিনি হেরা গুহাতে ই‘তিকাফ করেন। অতঃপর শেষ দশকে ক্বদর রাতে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। যা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ২৩ বছরে শেষ হয়। এজন্য তাঁর সত্য স্বপ্নকে নবুয়তের ৪৬ ভাগের একভাগ বলা হয়’।[2]
ইমাম আহমাদ হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণনা করেন যে, প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর ঘুমন্ত অবস্থায় সত্যস্বপ্নের মাধ্যমে ‘অহি’ নাযিলের সূচনা হয়। স্বপ্নে তিনি যা দেখতেন, প্রভাত সূর্যের মত তা সত্য হয়ে দেখা দিত। এরপর তাঁর মধ্যে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা দেখা দেয়। তখন তিনি হেরা গুহায় গিয়ে রাত কাটাতে থাকেন। তিনি একত্রে কয়েকদিনের খাদ্য সাথে নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে খাদীজার কাছে ফিরে এসে আবার খাদ্য নিয়ে যেতেন। এইভাবে একরাতে তাঁর নিকটে হেরা গুহাতে সত্য এসে হাযির হ’ল। ফেরেশতা তাঁকে বলল, اِقْرَأْ (তুমি পড়)। রাসূল (ছাঃ) বললেন,مَا أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানি না’। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তখন ফেরেশতা আমাকে বুকে ধরে জোরে চাপ দিল। তাতে আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। তখন বলল, اِقْرَأْ ‘পড়’। বললাম, ‘পড়তে জানিনা’। এবার দ্বিতীয়বার চাপ দিয়ে বলল اِقْرَأْ ‘পড়’। বললাম, পড়তে জানিনা। অতঃপর তৃতীয়বার চাপ দিয়ে বলল, اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’- এখান থেকে পরপর পাঁচটি আয়াত। রাসূল (ছাঃ) পাঠ করলেন। তারপর ফেরেশতা চলে গেল এবং রাসূল (ছাঃ) বাড়ীতে ফিরে এলেন। এ সময় ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি খাদীজাকে বললেন, زَمِّلُوْنِىْ زَمِّلُوْنِىْ ‘আমাকে চাদর মুড়ি দাও! আমাকে চাদর মুড়ি দাও’। অতঃপর চাদর মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ থাকার পর তিনি বললেন, يَا خَدِيْجَةُ مَا لِىْ ‘খাদীজা আমার কি হ’ল’? তারপর তিনি সব খুলে বললেন এবং শেষে বললেন, قَدْ خَشِيْتُ عَلَىَّ ‘আমি মৃত্যুর আশংকা করছি’। তখন খাদীজা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, كَلاَّ أَبْشِرْ، فَوَاللهِ لاَ يُخْزِيْكَ اللهُ أَبَدًا، فَوَاللهِ إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَصْدُقُ الْحَدِيثَ، وَتَحْمِلُ الْكَلَّ، وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ، وَتَقْرِى الضَّيْفَ، وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ ‘কখনোই না। সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ কখনোই আপনাকে লজ্জিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, সত্য কথা বলেন, গরীবের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথি সেবা করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’। অতঃপর খাদীজা তাঁকে নিয়ে চাচাতো ভাই অরাক্বা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। যিনি জাহেলী যুগে ‘নাছারা’ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আরবী লিখতে পারতেন এবং ইনজীল থেকে আরবী করতেন। তিনি অতি বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা তাকে বললেন, ভাই দেখুন আপনার ভাতিজা কি বলছেন। অরাক্বা বললেন, বল ভাতিজা, কি দেখেছ? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সব খুলে বললেন, যা তিনি দেখেছেন। জওয়াবে অরাক্বা বললেন, هَذَا النَّامُوسُ الَّذِى أُنْزِلَ عَلَى مُوسَى، يَا لَيْتَنِى فِيهَا جَذَعًا، يَا لَيْتَنِىْ أَكُونُ حَيًّا، حِينَ يُخْرِجُكَ قَوْمُكَ– ‘এতো সেই ফেরেশতা যিনি মূসার উপর অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন যুবক থাকতাম। হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম। যেদিন তোমার সম্প্রদায় তোমাকে বহিষ্কার করবে’। একথা শুনে রাসূল (ছাঃ) বলে উঠলেন أَوَمُخْرِجِىَّ هُمْ ؟ ‘ওরা কি আমাকে বের করে দেবে?’ অরাক্বা বললেন, نَعم، لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمِثْلِ مَا جِئْتَ بِهِ إِلاَّ عُودِىَ ‘হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি’। ছহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় إِلاَّ أُوذِىَ (যিনি নির্যাতিত হননি) এসেছে।[3] অতঃপর তিনি বললেন, إِنْ يُدْرِكْنِى يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا ‘যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে যথাযোগ্য সাহায্য করব’।
এর কিছু দিনের মধ্যেই অরাক্বা মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় ‘অহি’ নাযিল বন্ধ হয়ে যায়। যাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বারবার পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাতে থাকেন ফেরেশতাকে দেখার আশায়। হঠাৎ একদিন জিব্রীল তাঁর সামনে স্বরূপে প্রকাশিত হ’লেন এবং বললেন, يَا مُحَمَّدُ إِنَّكَ رَسُوْلُ اللهِ حَقََّا ‘হে মুহাম্মাদ অবশ্যই আপনি নিশ্চিতভাবে আল্লাহর রাসূল’। একথা শোনার পরে তাঁর অস্থিরতা দূর হয়ে গেল এবং হৃদয় ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি ফিরে এলেন এবং এরপর থেকে কিছু দিন অহি-র আগমন বন্ধ রইল।
একদিন তিনি রাস্তায় চলা অবস্থায় একটি আওয়ায শুনে উপরদিকে তাকিয়ে জিব্রীলকে আবির্ভূত হ’তে দেখেন, যেভাবে তিনি তাকে হেরা গুহায় দেখেছিলেন। এদিন তিনি তাকে আকাশ ও পৃথিবীব্যাপী চেয়ারের উপর বসা অবস্থায় দেখে ভীত হয়ে পড়েন এবং বাড়ীতে এসে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। তখন সূরা মুদ্দাছছির নাযিল হয়। এরপর থেকে অহী নাযিল চলতে থাকে (তাফসীর ইবনু কাছীর)।[4]
★তাফসীর :
(১) اِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’।
অর্থ اقرأ مستعينًا باسم الله ‘আল্লাহর নামে সাহায্য চেয়ে তুমি পাঠ কর’। এই আয়াতটি সহ পরপর পাঁচটি আয়াত মানবজাতির জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ হতে শেষনবী (ছাঃ)-এর নিকটে প্রেরিত সর্বপ্রথম প্রত্যাদেশ। এটাই ছিল আখেরী যামানার মানুষের নিকট আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত সর্বপ্রথম আসমানী বার্তা। ইবনু কাছীর বলেন, وهن أول رحمة رحم الله بها العباد وأول نعمة أنعم الله بها عليهم- ‘এগুলি ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার উপরে প্রথম রহমত এবং তাদের উপরে আল্লাহর প্রথম নে‘মত’ (ইবনু কাছীর)।
কুরতুবী বলেন, এখানে পড়ার বিষয়টি উহ্য রাখা হয়েছে। যার অর্থ ‘কুরআন’ অর্থাৎ اقرأ القرآن وافتتحه باسم الله ‘কুরআন পড় এবং বিসমিল্লাহ বলে শুরু কর’ (কুরতুবী)। এতে বুঝা যায় যে, প্রতিটি সূরার শুরুতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ পাঠ করা উচিত। সম্ভবতঃ একারণেই প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ লিখিত হয়েছে। তবে বক্তৃতা বা আলোচনার মাঝে যতবার কুরআনের আয়াত পাঠ করা হয়, ততবার ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠের কোন দলীল নেই বরং শুরুতে একবার বলাই যথেষ্ট।
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ (nahl 98)
এর দ্বারা একটি বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বান্দার প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় নে‘মতটির অবতরণের সূচনা করা হ’ল তার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর পবিত্র নামে। এতে একথাও বুঝানো হ’ল যে, যে কোন শুভ কাজের সূচনা আল্লাহর নামে ও তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে করতে হবে। অত্র আয়াতে আল্লাহর গুণবাচক নাম সমূহের মধ্য থেকে প্রধান দু’টি ছিফাত উল্লেখ করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহকে সবাই মানে। যেমন তিনি বলেন, وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُوْلُنَّ اللهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ- ‘আর যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। তুমি বল সকল প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু ওদের অধিকাংশ কোন জ্ঞান রাখে না’ (লোকমান ৩১/২৫)। সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহকে মানলেও পালনকর্তা বা ‘রব’ হিসাবে মানতে অনেকে অস্বীকার করে। যেমন ফেরাঊন প্রকাশ্যে নিজেকে ‘বড় রব’ বলে দাবী করে বলেছিল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى ‘আমি তোমাদের বড় পালনকর্তা (নাযে‘আত ৭৯/২৪)। সম্ভবতঃ সেকারণেই আল্লাহ প্রথমে ‘রব’ এবং পরে ‘খালেক’ ছিফাতটি এনেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বান্দাকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন যে, প্রকৃত ‘রব’ একমাত্র আমিই। আমিই তোমাদেরকে আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে, পানি দিয়ে, খাদ্য-শস্য দিয়ে, রোগে আরোগ্য দান করে, জ্ঞান ও চিন্তাশক্তি দিয়ে দুনিয়ার এ মুসাফিরখানায় লালন-পালন করে থাকি। আমার এ পালনকার্যে আমি একক। আমার কোন শরীক নেই। রুবূবিয়াতের সকল ক্ষমতা কেবলমাত্র আমারই হাতে।
আল্লাহ সকলের পালনকর্তা হ’লেও ‘তোমার প্রভু’ (رَبِّكَ) বলে রাসূলকে খাছ করার মাধ্যমে তাঁর মর্যাদাকে উচ্চ শিখরে উন্নীত করা হয়েছে। অতঃপর ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (الَّذِيْ خَلَقَ) বলে সৃষ্টির বিষয়টি সকল সৃষ্টিকুলের প্রতি আরোপ করা হয়েছে।
(২) خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড হ’তে’।
এখানে মানুষকে খাছ করার মাধ্যমে সকল সৃষ্টির মধ্যে তার মর্যাদাকে সমুন্নত করা হয়েছে। অতঃপর তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সেরা সৃষ্টি হ’লেও তুমি একথা ভুলে যেয়ো না যে, তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে নিকৃষ্ট ‘জমাট রক্তপিন্ড’ হ’তে। ‘জমাট রক্তপিন্ড’ হ’ল মধ্যবর্তী অবস্থা। এর পূর্বে সে ছিল সূক্ষ্ম একটি পানি বিন্দু। পিতার শুক্রাণু ও মায়ের ডিম্বাণু যদি আল্লাহর হুকুমে মিলিত হয়, তবেই সেটা পরে রক্তবিন্দুতে পরিণত হয়। অতঃপর চার মাস বয়সে সন্তানের রূপ ধারণ করে এবং আল্লাহর হুকুমে তাতে রূহ আগমন করে।[6] এখানে ‘জমাট রক্ত’ বলে সৃষ্টির পূর্বাপর অবস্থা সমূহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যাতে বান্দা তার নিজের সৃষ্টিতত্ত্ব ও সৃষ্টি কৌশল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়। আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে বিস্তৃত তথ্যাবলী উপস্থাপন করেছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতের মিলিত ব্যাখ্যায় একথা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের মূল উদ্দেশ্য হবে স্রষ্টাকে জানা এবং তাঁর প্রেরিত বিধানসমূহ অবগত হওয়া। দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে, প্রকৃত শিক্ষা হ’ল সেটাই যা খালেক্ব-এর জ্ঞান দান করার সাথে সাথে ‘আলাক্ব-এর চাহিদা পূরণ করে। অর্থাৎ নৈতিক ও বৈষয়িক জ্ঞানের সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থাই হ’ল পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা। মানবীয় জ্ঞানের সম্মুখে যদি অহি-র জ্ঞানের অভ্রান্ত সত্যের আলো না থাকে, তাহ’লে যেকোন সময় মানুষ পথভ্রষ্ট হবে এবং বস্ত্তগত উন্নতি তার জন্য ধ্বংসের কারণ হবে। বিগত যুগে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, শো‘আয়েব, ফেরাঊন ও তার কওমের পরিণতি এবং আধুনিক যুগে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং সাম্প্রতিক কালের বসনিয়া, সোমালিয়া, কসোভো এবং সর্বশেষ ইরাক ও আফগানিস্তান ট্রাজেডী এসবের বাস্তব প্রমাণ বহন করে।
(৩) إِقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ‘পড়! আর তোমার পালনকর্তা বড়ই দয়ালু’।
প্রথম আয়াতে বর্ণিত إِقْرَأْ থেকে পুনরায় তাকীদ স্বরূপ এসেছে اِقْرَأْ ‘তুমি পড়’। এখানেই বাক্য শেষ হয়েছে। অথবা الْأَكْرَمُ إِقْرَأْ وَرَبُّكَ ‘তুমি পড়। আর তোমার প্রভু তোমাকে সাহায্য করবেন ও বুঝাবেন। কেননা তিনি বড়ই দয়ালু (কুরতুবী)। এখানে প্রথম আয়াতটি আল্লাহর রুবূবিয়াতের সাথে সম্পৃক্ত এবং অত্র আয়াতটি তাঁর প্রেরিত শরী‘আতের সাথে সম্পৃক্ত। কেননা কলম দিয়ে কুরআন-হাদীছ লিখিত ও সংরক্ষিত হয়। অহি নাযিলের শুরুতেই বান্দার প্রতি আল্লাহর এই ধরনের বার বার পড়ার নির্দেশ বিগত কোন ইলাহী গ্রন্থে ছিল বলে জানা যায় না। লক্ষণীয় যে, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের কোনটাই এখানে বলা হয়নি। কারণ আল্লাহ চান মানুষ প্রথমে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করুক। অতঃপর সচেতনভাবেই তাওহীদের সাক্ষ্য দিক। অতঃপর ভক্তিভরে আল্লাহর ইবাদত করুক। শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি যে কুরআনের এত বড় তাকীদ, সেই কুরআনের অনুসারীদের বিশ্বব্যাপী আজ এত দুরবস্থা কেন? কারণ প্রধানতঃ একটাই- তারা কুরআনী শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিজ্ঞানচর্চা তারা যেন ভুলেই গেছে- যা ছিল এককালে তাদের একক উত্তরাধিকার।
وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ‘আর তোমার পালনকর্তা বড়ই দয়ালু"
الأكرم অর্থ كريم দয়ালু। অথবা حليم অর্থ ধৈর্য ও স্থৈর্যের অধিকারী। যিনি বান্দার অজ্ঞতা ও মূর্খতায় ধৈর্য ধারণ করেন ও শাস্তি দিতে দেরী করেন। তবে কুরতুবী বলেন, প্রথমটাই অর্থের সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ (কুরতুবী)। এখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সবচেয়ে বড় দয়ালু। কারণ তিনি মুমিন-কাফির সবাইকে আলো-বাতাস ও খাদ্য-পানীয় দিয়ে উদারভাবে প্রতিপালন করে থাকেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি বান্দাকে জ্ঞানরূপী মহা নে‘মত দান করেছেন। যার ফলে সে মূর্খতার অন্ধকার হতে মুক্তি পেয়েছে।
(৪) اَلَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ‘যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন’।
লেখনীর মাধ্যমে শিক্ষাদানকে আল্লাহ এখানে বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহের সবচেয়ে বড় নিদর্শন হিসাবে পেশ করেছেন।
ক্বাতাদাহ বলেন, ‘কলম হ’ল আল্লাহর বিরাট একটি নে‘মত। যা না হ’লে দ্বীন ও জীবন-জীবিকা কোনটাই সঠিকভাবে চলতো না’। قَلَمَ يَقْلِمُ قَلْمًا অর্থ কর্তন করা। যেমন নখ কাটা হয়। কলমের মাথা কেটে সরু করা হয় বলেই একে ‘কলম’ বলা হয়েছে। এযুগের বৈদ্যুতিক লেখনী মূলতঃ কলমের লেখনীর অনুকরণ মাত্র।
বিদ্বানগণ বলেন, কলম তিন প্রকার :
ওবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ فَقَالَ لَهُ اكْتُبْ فَقَالَ مَا أَكْتُبُ؟ قَالَ اكْتُبِ الْقَدَرَ مَا كَانَ وَمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى الأَبَدِ ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন। অতঃপর তাকে বলেন, লেখ। সে বলল, কি লিখব? আল্লাহ বললেন, তাক্বদীর লিখ। তখন সে লিখল যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছ ঘটবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত’।[7] আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখাৎ অন্য বর্ণনায় এসেছে, لَمَّا خَلَقَ اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِى كِتَابِهِ فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ إِنَّ رَحْمَتِى سَبَقَتْ غَضَبِى ‘মাখলূক্বাত সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তাঁর কিতাবে লিখেন, যা তখন তাঁর নিকটে আরশের উপরে ছিল- ‘নিশ্চয়ই আমার রহমত আমার ক্রোধের উপরে জয়লাভ করে’।[8]
আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِيْنَ،كِرَاماً كَاتِبِيْنَ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের উপরে রয়েছে তত্ত্বাবধায়কগণ’। ‘সম্মানিত লেখকগণ’ (ইনফিত্বার ৮২/১০-১১)। অর্থাৎ বান্দার প্রতি মুহূর্তের আমলসমূহ লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাগণ সর্বদা কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করছেন। এতে বুঝা যায় যে, দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বত্র কলমের সাহায্যেই সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হয়। কলম আল্লাহ পাকের দেয়া এক অপূর্ব নে‘মত। যা মানুষের মনের কথা অবলীলাক্রমে লিখে ফেলে। মনের সাথে কলমের এই সংযোগ, মনের কথা কলমে প্রকাশের ক্ষমতা, আল্লাহর দেয়া এমন এক অমূল্য নে‘মত, যার কোন তুলনা নেই, যার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না। যদি কলম না থাকতো, তাহ’লে দ্বীন-ধর্ম, সমাজ-রাষ্ট্র, আইন-আদালত, সাহিত্য-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য কোন কিছুই ধরে রাখা সম্ভব হতো না। সবই বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যেত। কলম হ’ল মনের ও যবানের প্রতিনিধি। আল্লাহর হুকুমে মানুষের মনের মধ্যে যে ভাবের উদয় হয়, সেটাই মুখের ভাষায় বর্ণিত হয় ও কলমে লিখিত হয়। আল্লাহ বলেন, الرَّحْمَنُ، عَلَّمَ الْقُرْآنَ، خَلَقَ الْإِنْسَانَ، عَلَّمَهُ الْبَيَانَ- ‘রহমান! যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন’ (রহমান ৫৫/১-৪)। অর্থাৎ আল্লাহর রহমানিয়াতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হ’ল মানুষকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া। যা তিনি অন্য কোন সৃষ্টিকে দেননি। কলম উক্ত ভাষারই প্রতিনিধিত্ব করে। নুযূলে অহি-র শুরুতেই আল্লাহ এভাবে কলমের মাধ্যমে শিক্ষাদানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।
(৫) عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‘শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না’।
অর্থাৎ অজানা বিষয়ে জ্ঞানদান করাটাই বান্দার প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এবং তাঁর দয়ালু হওয়ার অন্যতম প্রধান দলীল। মূলতঃ আল্লাহর নিকট হ’তে অজানা বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের কারণেই আদম (আঃ) ফেরেশতাদের উপরে জয়লাভ করেছিলেন (বাক্বারাহ ২/৩১)। অন্যান্য সকল সৃষ্টির উপরে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূল নিহিত রয়েছে ইলমের মধ্যে। মানুষের মধ্যে জ্ঞানের প্রয়োজনীয় পরিমাণ অংশ দিয়ে দেয়া হয়েছে। যে মানুষ যত বেশী কুরআন ও হাদীছের জ্ঞানচর্চা করবে, সে তত বেশী অজানা বিষয় জানতে পারবে ও নিত্য-নতুন কল্যাণ লাভে ধন্য হবে। আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমরা তাদেরকে অবশ্যই আমাদের পথসমূহে পরিচালিত করব’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)। কিন্তু মুসলমান বর্তমানে সেই আসন থেকে বহু দূরে ছিটকে পড়েছে জ্ঞানচর্চা হ’তে দূরে থাকার কারণে। ফলে নিজের ঘরের বহু বিষয় আজও তার অজানা রয়েছে। সে জানেনা তার মাটির নীচে তার পানির নীচে এমনকি তার আকাশে আল্লাহর কত অগণিত নে‘মত লুকিয়ে রয়েছে।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ও আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা বলেছেন যে, قَيِّدُوا الْعِلْمَ بِالْكِتَابَةِ ‘তোমরা ইলমকে লেখনীর দ্বারা বন্দী করে ফেলো’।[9]
অজানা বিষয়ে জ্ঞান লাভের বিষয়টি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্যেও প্রযোজ্য। যেমন আল্লাহ বলেন, وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ ‘এবং তিনি তোমাকে শিখিয়েছে যা তুমি জানতে না’ (নিসা ৪/১১৩)। এটি সকল মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। যেমন আল্লাহ বলেন, وَاللهُ أَخْرَجَكُمْ مِّنْ بُطُوْنِ أُمَّهَاتِكُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ شَيْئاً ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করে এনেছেন এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না’ (নাহল ১৬/৭৮)।[10]
উম্মী নবী :
দুষ্টমতি লেখকগণ রাসূল (ছাঃ)-কে ভন্ডনবী প্রমাণ করার জন্য তাকে অরাক্বা বিন নওফেলের নিকট থেকে ইঞ্জীল শিক্ষা করে, অতঃপর তা কুরআন হিসাবে তিনি প্রচার করেছেন বলে তাফসীর করে থাকেন। এটি যে ডাহা মিথ্যা পূর্বে বর্ণিত হাদীছ থেকেই বুঝা যায়। রাসূল (ছাঃ) ইতিপূর্বে লেখাপড়া কোথাও শিখেন নি, এটি সর্ববাদী সম্মত বিষয়। এর মধ্যে হিকমত এই যে, যেন পৃথিবীর কোন পন্ডিত তাঁকে নিজের শিক্ষক বলে দাবী করতে না পারেন। যুগে যুগে বাতিলপন্থীদের এ ধরনের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আল্লাহ বলেন, وَمَا كُنْتَ تَتْلُو مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلاَ تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ إِذًا لاَرْتَابَ الْمُبْطِلُونَ ‘তুমি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করোনি এবং স্বহস্তে কোন কিতাব লেখনি, যে বাতিলপন্থীরা সন্দেহ পোষণ করবে’ (আনকাবূত ২৯/৪৮)। এমনকি তাঁর ঈমান আনার বিষয়েও আল্লাহ বলেন, مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتَابُ وَلاَ الْإِيْمَانُ ‘তুমি জানতে না কিতাব কি বা ঈমান কি?’ (শূরা ৪২/৫২)। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) ‘নিরক্ষর’ (Unlettered) ছিলেন। কিন্তু ‘অজ্ঞ’ (Illiterate) ছিলেন না। অতএব নবুঅত ও রিসালাত স্রেফ আল্লাহ প্রেরিত অনুগ্রহ। এটি মানুষের অর্জিত বিষয় নয়।
ইলম অর্জনের গুরুত্ব :
বর্ণিত আয়াতগুলিতে দ্বীনী ইলম অর্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে সম্ভবতঃ এমন কোন ধর্মগ্রন্থ নেই, যার প্রথম বাক্য হ’ল ‘পড়’। তৃতীয় আয়াতের শুরুতে পুনরায় তাকীদ দিয়ে বলা হয়েছে ‘পড়’। এর পরেই চতুর্থ আয়াতে কলমের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। এতে পড়া ও লেখা দু’টিই যে ইলমের মাধ্যম, সেকথা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাই ইলম অর্জন করা আদম সন্তানের প্রতি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পক্ষ হ’তে প্রথম নির্দেশ হিসাবে নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয’।[11] এর অর্থ দ্বীনের মৌলিক বিশ্বাস, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা সকল মুসলিম ব্যক্তির উপর ফরয। তিনি আরও বলেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনের বুঝ দান করেন’।[12] এছাড়াও সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে সাধ্যমত জ্ঞানার্জন করা ও সেখান থেকে কল্যাণ আহরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা বান্দার জন্য অবশ্য কর্তব্য (আলে ইমরান ৩/১৯১)।
উপরে বর্ণিত পাঁচটি আয়াত হ’ল আল্লাহর পক্ষ হ’তে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য নাযিলকৃত পবিত্র কুরআনের প্রথম ‘অহি’। আয়াতগুলি নাযিলের পরে বিশুদ্ধ মতে ১০ দিন আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি (আর-রাহীক্ব, পৃঃ ৬৯)। অহি-র এই বিরতিকাল ‘ফাৎরাতুল অহি’ (فترة الوحى) নামে খ্যাত। বক্তা গুরুত্বপূর্ণ কোন কথা বলার পর শ্রোতাকে তার মর্মার্থ অনুধাবনের জন্য যেমন সময় দিয়ে থাকেন, আল্লাহ এই গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি আয়াত নাযিলের পর তার রাসূলকে যেন তার মর্ম ও গুরুত্ব অনুধাবনের সুযোগ দিলেন। কেবল রাসূল নন, সকল যুগের সকল মানুষ আয়াতগুলির গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করে বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। যেমন পাঁচটি আয়াতের প্রথম দু’টি আয়াত এবং তৃতীয় আয়াতের প্রথমাংশে তাওহীদে রুবূবিয়াতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, যার কোন শরীক নেই। অতঃপর তৃতীয় আয়াতের শেষাংশ থেকে পঞ্চম আয়াত পর্যন্ত নবুঅতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। যা কেবলমাত্র শ্রবণ, লিখন ও প্রচারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, নবুঅত ও রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ব্যতীত আল্লাহর বিধান জানা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যে বিধান জানা ও না মানা পর্যন্ত দুনিয়া ও আখেরাতে প্রকৃত কল্যাণ লাভ আদৌ সম্ভব নয়।
এখানে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, একজন উম্মী নবীকে সর্বপ্রথম নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে ‘তুমি পড়’। একজন নিরক্ষর নবীকে সর্বপ্রথম বলা হচ্ছে কলমের সাহায্যে ইলম শিক্ষার কথা। এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, কুরআন সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর কালাম, যা রাসূলের মুখ দিয়ে বের করা হয়েছে মাত্র। এর শব্দ, বাক্য বা অর্থ কোনটাই রাসূল (ছাঃ)-এর নিজস্ব নয়। কারণ তিনি নিজেই ছিলেন উম্মী ও নিরক্ষর। তাঁর পক্ষে কুরআনের ন্যায় সর্বোচ্চ অলংকার সমৃদ্ধ এবং সর্বোচ্চ বিজ্ঞান, অতীত ইতিহাস ও ভবিষ্যদ্বাণী সমৃদ্ধ আয়াতসমূহ বর্ণনা করা একেবারেই অকল্পনীয় বিষয়। সুবহানাল্লা-হি ওয়া বেহামদিহী, সুবহানাল্লা-হিল ‘আযীম।
[1]. পরবর্তী সূরা ক্বদরে ‘নুযূলে কুরআনের সূচনা’ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে।
[2]. বুখারী হা/৬৯৮৯; মুসলিম হা/২২৬৩।
[3]. বুখারী হা/৪৯৫৩।
[4]. বুখারী হা/৪; মুসলিম হা/১৬১; আহমাদ হা/২৬০০১; মিশকাত হা/৫৮৪১-৪৩ ‘অহীর সূচনা’ অনুচ্ছেদ।
[5]. নিসা ৪/১; বুখারী হা/৩৩৩১, মুসলিম হা/১৪৬৮, মিশকাত হা/৩২৩৮-৩৯।
[6]. বুখারী হা/৭৪৫৪, মুসলিম হা/২৬৪৩; মিশকাত হা/৮২।
[7]. তিরমিযী হা/২১৫৫; মিশকাত হা/৯৪।
[8]. বুখারী হা/৭৫৫৪, মুসলিম হা/২৭৫১; মিশকাত হা/৫৭০০।
[9]. হাকেম ১/১০৬ হা/৩৬০; দারেমী হা/৪৯৮, মওকূফ ছহীহ।
[10]. কিছু লোক প্রচার করে থাকে যে, বড় পীর আব্দুল কাদের জীলানী (৪৭০-৫৬১ হিঃ) মায়ের গর্ভ থেকে ১৮ পারা কুরআনের হাফেয অবস্থায় ভূমিষ্ট হয়েছিলেন। অথচ আল্লাহ বলছেন, ‘তোমরা কিছুই জানতে না’ (নাহল ১৬/৭৮)। অন্যদিকে রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন, وما كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلاَ الْإِيمَانُ ‘তুমি জানতে না কিতাব কি বা ঈমান কি’? (শূরা ৪২/৫২)।
[11]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৯১৩, ৩৯১৪।
[12]. বুখারী হা/৭১, মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/২০০।
No comments