রাসুল (স:) এই সূরাটি নিয়মিত পাঠ করতেন। হাদীসে এসেছে - রাসুল (স:) প্রত্যেক রাতে সুরা হামীম সাজদাহ এবং সুরা মুলক পাঠ না করে ঘুমাতেন না।
وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ۚ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ} [فصلت : 37]
ঈসায়ী ৬১০ সনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নবুওয়াত লাভ করেন।প্রথম তিনটি বছর তিনি নিরবে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ করেন।অতপর তিনি সরবে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ শুরু করেন।কিছুসংখ্যক সত্যসন্ধানী এবং সাহসী যুবক-যুবতী তাঁর আহ্বানে সাড়া দেন। আবু জাহল আমর ইবনু হিশাম, উতবা ইবনু রাবীয়া, শাইবা ইবনু রাবীয়া, আল ওয়ালিদ ইবনুল মুগীরা, উমাইয়া ইবনু খালাফ, আস ইবনু ওয়াইল প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তাঁর আহ্বান কবুল করেনি। ফলে আম-জনতা ইসলাম গ্রহণ করার সাহস পায় নি ইসলাম-বিদ্বেষীরা বিরোধিতা শুরু করে। প্রথমে ঠাট্টা-বিদ্রুপ,অতপর গালমন্দ,অতপর হুমকি-ধমকি,অতপর অপপ্রচার এবং শেষাবধি দৈহিক নির্যাতন করে ইসলামের আলো নিভিয়ে দিতে চায় দুশমনেরা। মুমিনগণ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন।
[উসমান ইবনু আফফান (রা), তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা), বিলাল ইবনু রাবাহ (রা), আবু ফাকীহা (রা), ইয়াসির (রা), সুমাইয়া বিনতু খুব্বাত (রা), উম্মু শুরাইক (রা), লুবাইনা (রা), খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা) প্রমুখ দৈহিকভাবে নির্যাতিত হন।]
ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ঘরদোর, বাগ-বাগিচা, পশু-পাল, ব্যবসা-বাণিজ্য-ইত্যাদি পেছনে ফেলে একদল মুমিন হাবশায় হিজরাত করেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তখনো ইসলাম গ্রহণ করেন নি। হামজা ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রা) তখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
(২) মুমিনদের ওপর যুলম নির্যাতন চালানোর কারণে ইসলাম বিরোধীদেরকে আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে। [হূদ (আ) এর কাউম বানু আদ এবং ছালিহ (আ)-এর কাউম বানু সামূদের ওপর নাযিলকৃত আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।]
(৩) নির্যাতিত মুমিনদেরকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে।
(৪) আর মুমিনদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ তো তারা যারা সর্বাবস্থায় সৎ কাজ করে, লোকদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকে এবং দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করে : অবশ্যই আমি মুসলিমদের একজন।
★তাফসীরঃ
১ম আয়াতঃ-✅ اِنَّ الَّذِیْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَیْهِمُ الْمَلٰٓئِكَةُ اَلَّا تَخَافُوْا وَ لَا تَحْزَنُوْا وَ اَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِیْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ
قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ. অর্থ : ‘তারা বলে : আল্লাহ আমাদের রব।’
‘রব’ মানে প্রভু, মুনীব, প্রতিপালক, তত্ত্বাবধায়ক, ক্ষমতাশালী-প্রতাপশালী-কর্তৃত্বশীল সত্তা ইত্যাদি।
“আল্লাহ আমাদের রব”- এই ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে -
-আল্লাহকে “প্রভু” বলে মেনে নেওয়া এবং নিজেরা তাঁর “আবদ” রূপে তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল জীবন যাপনের সংকল্প ব্যক্ত করা।
-আল্লাহকে “মুনীব” বলে মেনে নেওয়া এবং নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে আল্লাহমুখী করা ও কর্মধারাকে আল্লাহমুখী করা।
-আল্লাহকে “প্রতিপালক” বলে বিশ্বাস করা এবং তাঁর প্রতিপালন ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হওয়া।
-আল্লাহকে “তত্ত্বাবধায়ক” বলে মানা এবং তাঁর তত্ত্বাবধান ব্যবস্থার অধীনে আছি বলে বিশ্বাস রাখা।
-একমাত্র আল্লাহকে “ক্ষমতাশালী-প্রতাপশালী- কর্তৃত্বশীল” সত্তা রূপে গ্রহণ করে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পী হওয়া।
-একমাত্র আল্লাহর বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব (সার্বভৌমত্ব) প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা। কারণ, তাঁর নির্দেশ হচ্ছে- “ওয়া রাব্বাকা ফাকাব্বির।”
ثُمَّ اسْتَقَامُوْا.অর্থ : ‘অতপর ইসতিকামাত করে।’ [অর্থাৎ দৃঢ়তা-অটলতা-অবিচলতা অবলম্বন করে।]
(১) আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “বহু মানুষ আল্লাহকে তাদের রব বলে ঘোষণা করে, কিন্তু অধিকাংশ আবার কাফির হয়ে যায়। দৃঢ়পদ সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু পর্যন্ত এই আকীদা আঁকড়ে ধরে থাকে।” [আনাস ইবনু মালিক (রা), সুনানু আন-নাসায়ী, ইবনু আবী হাতিম, ইবনু জারীর।]
(২) আবু বাকর আছ্ ছিদ্দিক (রা) বলেছেন, “[দৃঢ়পদ ওই ব্যক্তিরা যারা ঈমান আনার পর] আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করে নি, তাঁকে ছাড়া আর কোন উপাস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় নি।” [ইবনু জারীর]
(৩)উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, “আল্লাহর শপথ, নিজ আকীদায় দৃঢ় ও স্থির তারাই যারা দৃঢ়ভাবে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, শিয়ালের মতো এই দিক থেকে ঐ দিক, ঐ দিক থেকে এই দিকে ছুটে বেড়ায় না।” [ইবনু জারীর]
(৪) উসমান ইবনু আফফান (রা) বলেছেন, “(দৃঢ়পদ তারা) যারা নিজের আমলকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।” [কাশ্ শাফ]
(৫) আলী ইবনু আবী তালিব (রা) বলেছেন, “(দৃঢ়পদ তারা যারা) আল্লাহর নির্ধারিত ফারযগুলো একনিষ্ঠভাবে আদায় করছে। [কাশ্ শাফ]
(৬) দৃঢ়পদ ব্যক্তিদের সম্পর্কে এই যুগের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) বলেছেন, “অর্থাৎ হঠাৎ কখনো রব বলে ঘোষণা করে থেমে যায় নি এবং এমন ভ্রান্তিতেও লিপ্ত হয় নি যে আল্লাহকে তো রব বলে ঘোষণা করেছে, আবার তার সাথে অন্যদেরকেও রব বলে মেনে নিয়েছে। বরং একবার এই আকীদা গ্রহণ করার পর সারা জীবন এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে। এর পরিপন্থী কোন আকীদা গ্রহণ করে নি কিংবা এর সাথে কোন বাতিল আকীদার সংমিশ্রণও ঘটায় নি এবং নিজের কর্মজীবনে তাওহীদী আকীদার দাবিগুলো পূরণ করেছে।”
দ্রষ্টব্য : তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, সূরা হামীমুস সাজদাহর তাফসীরের ৩৩ নাম্বার টীকা।
تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلئِكَةُ. অর্থ : ‘তাদের প্রতি ফেরেশতা নাযিল হয়।’
ফেরেশতাগণ আল্লাহর সাম্রাজ্যের বিশ্বস্ত কর্মচারী। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন তাঁদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন।
(১) একদল ফেরেশতা আল্লাহর আরশ বহন করেন।
(২) একদল ফেরেশতা পাহাড়-পর্বত তত্ত্বাবধান করেন।
(৩) একদল ফেরেশতা নদী-সাগর-মহাসাগর তত্ত্বাবধান করেন।
(৪) একদল ফেরেশতা বাতাস প্রবাহিত করেন।
(৫)একদল ফেরেশতা মেঘ পরিচালনা করেন।
(৬)একদল ফেরেশতা মানুষের তাকদীর লিপিবদ্ধ করেন।
(৭) একদল ফেরেশতা মানুষের রিযকের ব্যবস্থা করেন।
(৮) একদল ফেরেশতা মানুষের আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন।
(৯) একদল ফেরেশতা অবাধ্য জাতিকে শাস্তি দেন।
(১০)আজরাঈলের (আ) নেতৃত্বে একদল ফেরেশতা মানুষের রূহ কবজ করেন।
(১১) একদল ফেরেশতা মানুষকে কবরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
(১২) একদল ফেরেশতা জাহান্নামের তত্ত্বাবধান করেন।
(১৩) একদল ফেরেশতা জান্নাতের তত্ত্বাবধান করেন।
(১৪) অন্যতম ফেরেশতা ইসরাফিল (আ) বিউগল হাতে নিয়ে ফুঁ দেওয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।
(১৫) জিবরাঈল (আ) নবী রাসূলদের নিকট আল্লাহর ওহী নিয়ে আসতেন। এখন তিনি লাইলাতুল কাদরে বহু সংখ্যক ফেরেশতা নিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসেন।
এখানে বিশেষ এক শ্রেণীর ফেরেশতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে মাযলুম মুমিনদের মনে হিম্মাত, নিশ্চিন্ততা এবং প্রশান্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করেন। আর মুমিনদেরকে অনাগত সফলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
উপলব্ধি করা যায় এমন অবস্থায় ফেরেশতারা নাযিল হবে এবং ঈমানদারগণ চর্ম চোখে তাদের দেখবে কিংবা তাদের আওয়াজ কানে শুনতে পাবে এটা জরুরী নয়। যদিও মহান আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা ফেরেশতাকে প্রকাশ্যে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সাধারণত ঈমানদারদের কাছে বিশেষতঃ যখন তারা ন্যায় ও সত্যের দুশমনদের হাতে নাজেহাল হতে থাকে সেই সময় তাদের অবতরণ অমনুভূত পন্থায় হয় এবং তাদের কথা কানের পর্দায় প্রতিধ্বনিত হওয়ার পরিবর্তে হৃদয়ের গভীরে প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি হয়ে প্রবেশ করে। কোন কোন তাফসীরকার ফেরেশতাদের এই আগমনকে মৃত্যুর সময় কিংবা কবরে অথবা হাশরের ময়দানের জন্য নির্দিষ্ট বলে মনে করেছেন। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে সে সম্পর্কে যদি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা যায় তাহলে এই পার্থিব জীবনে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার জন্য যারা জীবনপাত করছে তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতরণের কথা বর্ণনা করাই যে এখানে মূল উদ্দেশ্য সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। যাতে তারা প্রশান্তি লাভ করতে পারে, মনোবল ফিরে পায় এবং এই অনুভূতিতে তাদের হৃদয়-মন পরিতৃপ্ত হয় যে, তারা সহযোগী ও বন্ধুহীন নয়, বরং আল্লাহর ফেরেশতারা তাদের সাথে আছে। যদিও মৃত্যুর সময়ও ফেরেশতারা ঈমানদারদের স্বাগত জানাতে আসে, কবরেও (আলমে বরযখ) তারা তাদের স্বাগত জানায় এবং যেদিন কিয়ামত হবে সেদিনও হাশরের শুরু থেকে জান্নাতে পৌঁছা পর্যন্ত সব সময় তারা তাদের সাথে থাকবে। তবে তাদের এই সাহচর্য সেই জগতের জন্য নির্দিষ্ট নয়, এ পৃথিবীতেও চলছে। কথার ধারাবাহিকতা বলছে, হক ও বাতিলের সংঘাতে বাতিলের অনুসারীদের সাথে যেমন শয়তান ও অপরাধীরা থাকে তেমনি ঈমানদারদের সাথে ফেরেশতারাও থাকে। একদিকে বাতিলপন্থীদের কৃতকর্মসমূহকে তাদের সঙ্গী-সাথীরা সুদৃশ্য করে দেখায় এবং তাদেরকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দেয় যে, হককে হেয় করার জন্য তোমরা যে জুলুম-অত্যাচার ও বে-ঈমানী করছো সেটিই তোমাদের সফলতার উপায় এবং এভাবে পৃথিবীতে তোমাদের নেতৃত্ব নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। অপরদিকে হকপন্থীদের কাছে আল্লাহর ফেরেশতারা এসে সেই সুখবরটি পেশ করে যা পরবর্তী আয়াতাংশে বলা হচ্ছে।
২য় আয়াত✅نَحْنُ اَوْلِیٰٓؤُكُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ فِی الْاٰخِرَةِۚ وَ لَكُمْ فِیْهَا مَا تَشْتَهِیْۤ اَنْفُسُكُمْ وَ لَكُمْ فِیْهَا مَاتَدَّعُوْنَؕ
আমরা এই দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাবে তাই পাবে। আর যে জিনিসেরই আকাঙ্খা করবে তাই লাভ করবে।
এটা একটা ব্যাপক অর্থবোধক কথা যা দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত ঈমানদারদের জন্য প্রশান্তির একটি নতুন বিষয় বহন করে। পৃথিবীতে ফেরেশতাদের এই উপদেশের অর্থ হচ্ছে, বাতিল শক্তি যতই পরাক্রমশালী ও স্বৈরাচারী হোক না কেন তাদের দেখে কখনো ভীত হয়ো না এবং হকের অনুসারী হওয়ার কারণে যত দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনাই সইতে হোক সেজন্য দূঃখ করবে না। কেননা, ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য এমন কিছু আছে যার কাছে দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত তুচ্ছ। মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা যখন এই কথাগুলো বলে তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, তুমি সামনে যে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছো সেখানে তোমার জন্য ভয়ের কোন কারণ নেই। কারণ, সেখানে জান্নাত তোমার জন্য অপেক্ষমান। আর দুনিয়াতে তুমি যা কিছু ছেড়ে যাচ্ছো সেজন্য তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই কেননা, এখানে আমি তোমাদের অভিভাবক ও বন্ধু। আলমে বরযখ ও হাশরের ময়দানে যখন ফেরেশতারা এ কথাগুলো বলবে তখন তার অর্থ হবে, এখানে তোমাদের জন্য কেবল শান্তি আর শান্তি। পার্থিব জীবনে তোমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছো সেজন্য দুঃখ করো না এবং আখেরাতে যা কিছু সামনে আসবে সেজন্য ভয় করবে না। কারণ, আমরা তোমাদেরকে সেই জান্নাতের সুসংবাদ জানাচ্ছি যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা হচ্ছে।
৩য় আয়াত✅نُزُلًا مِّنْ غَفُوْرٍ رَّحِیْمٍ۠
نُزُلاً مِّنْ غَفُوْرِ رَّحِيْمٍ. অর্থ : ‘ক্ষমাশীল মেহেরবান সত্তার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর আয়োজন।’
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দৃঢ়পদ মুমিনদের মেহমানদারীর জন্য জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন।
(১) জান্নাত মহাবিস্তৃত আরামদায়ক স্থান।
وَسَارِعُوْا اِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّموتُ وَالاَرْضُ ০
‘এবং দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত এবং জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা আসমান ও পৃথিবীর প্রশস্ততার সমান।’ সূরা আলে ইমরান \ ১৩৩
سَابِقُوْا اِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ والاَرْضِ ০
‘তোমরা প্রতিযোগিতা করে দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত এবং জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা আসমান ও পৃথিবীর প্রশস্ততার সমান।’ সূরা আল হাদীদ \ ২১
একজন কম মর্যাদাবান জান্নাতীও পাবেন বর্তমান পৃথিবীর দশ গুণ বড়ো স্থান।
(২) জান্নাত অগণিত অফুরন্ত নিয়ামতে পরিপূর্ণ স্থান।
لَهُمْ مَا يَشَائُوْنَ فِيْهَا وَلَدَيْنَا مَزِيْدٌ ০
‘সেখানে তারা যা চাইবে তা-ই পাবে। আর আমার কাছে আরো বহু কিছু রয়েছে তাদের জন্যে।’সূরা কা-ফ \ ৩৫
اَعَدَدْتُ لِعِبَادِىَ الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ اُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلى قَلْبِ بَشَرٍ ০
ছহীহ আল বুখারী।
আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার ছালিহ বান্দাদের জন্য এমন সব নিয়ামত মওজুদ করে রেখেছি যা কোন চোখ কখনো দেখে নি, যার কথা কোন কান কখনো শুনে নি এবং যার ধারণা কোন হৃদয়ে কখনো উদিত হয় নি।’
(৩) জান্নাতের জীবন অনন্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন রোগ-শোকযুক্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন অভাব-অনটনযুক্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন ক্ষয়যুক্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন মৃত্যুযুক্ত জীবন।
পক্ষান্তরে- জান্নাতের জীবন রোগ-শোক মুক্ত জীবন।
জান্নাতের জীবন অভাব-অনটন মুক্ত জীবন।
জান্নাতের জীবন ক্ষয় মুক্ত জীবন।
জান্নাতের জীবন মৃত্যু মুক্ত জীবন।
উল্লেখ্য যে- অনন্ত জীবন এবং অক্ষয় সাম্রাজ্য লাভের আকাংখা মানুষের মনের গভীরে প্রোথিত দুইটি প্রধান আকাংখা।
এই দুইটি আকাংখাকে উসকে দিয়ে ইবলীস আদম (আ)কে ধোঁকা দিয়েছিলো।
সে বলেছিলো- “ইয়া আদামু হাল আদুল্লুকা ‘আলা শাজারাতিল খুলদি ওয়া মুলকিন লা ইয়াবলা।” [সূরা তা-হা \ ১২০]
‘হে আদম, আমি কি তোমাকে এমন গাছের সন্ধান দেবো যার ফল খেলে তুমি অনন্ত জীবন ও অক্ষয় সাম্রাজ্য লাভ করবে।’
কিন্তু পৃথিবীর জীবনে মানুষের এই দুইটি আকাংখা পূর্ণ হবার নয়। এই দুইটি আকাংখা পূর্ণ হবার স্থান জান্নাত।
৪র্থ আয়াত✅وَ مَنْ اَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّنْ دَعَاۤ اِلَى اللّٰهِ وَ عَمِلَ صَالِحًا وَّ قَالَ اِنَّنِیْ مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ
وَمَنْ اَحْسَنَ قَوْلاً مِّمَّنْ دَعَا اِلَى اللهِ অর্থ : ‘ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে যে লোকদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকে।’
প্রতিদিন আমরা অসংখ্য কথা বলে থাকি। যেই কথাগুলো বলে আমরা লোকদেরকে আল্লাহর পথে ডাকি সেই কথাগুলোকেই সর্বোত্তম কথা বলে আল্লাহ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। অর্থাৎ এই কথা বলাতেই যেন আমরা ব্যস্ত থাকি সেই ব্যাপারে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন।
আবার আদ্-দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র (ক) কর্ম-কৌশল, (খ) দা‘ওয়াত প্রদানের কাংখিত মান এবং (গ) পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন আল কুরআনে নিম্নরূপ ধারণা ব্যক্ত করেছেন :
اُدْعُ اِلى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِىْ هِىَ اَحْسَنُ ط اِنَّ رَبَّكَ هُوَ اَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيْلِه وَهُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ০
‘তোমার রবের পথে লোকদেরকে ডাক বিজ্ঞতা সহকারে, সুন্দর বক্তব্যের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে যুক্তি-তর্ক কর অতীব উন্নত মানে। অবশ্যই তোমার রব ভালো করেই জানেন কে তাঁর পথ থেকে সরে গেছে এবং তিনি জানেন কে সঠিক পথ প্রাপ্ত।’আন-নাহল \ ১২৫
وَمَا عَلَى الرَّ سُوْلِ اِلاَّ الْبَلغُ الْمُبِيْنُ ০
‘আর সুস্পষ্টভাবে আমার পয়গাম (লোকদের কাছে) পৌঁছিয়ে দেওয়াই রাসূলের কর্তব্য।’সূরা আন্ নূর \ ৫৪, আল ‘আনকাবূত \ ১৮
اِنَّكَ لاَ تَهْدِىْ مَنْ اَحْبَبْتَ وَلكِنَّ اللهَ يَهْدِىْ مَنْ يَّشَاءُ ج وَهُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ০
‘তুমি যাকে চাও তাকেই হিদায়াত করতে পার না। আল্লাহ যাকে চান তাকেই হিদায়াত করেন। আর তিনি হিদায়াত প্রাপ্তদেরকে ভালো করেই জানেন।’সূরা আল কাসাস \ ৫৬
اِنْ تَحْرِصْ عَلى هُدهُمْ فَاِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِىْ مَنْ يُّضِلُّ وَمَا لَهُمْ مِّنْ نّصِرِيْنَ ০
‘তুমি তাদের হিদায়াতের জন্য যতোই লালায়িত হওনা কেন আল্লাহ যাদেরকে গুমরাহ করে দিয়েছেন তাদেরকে হিদায়াত দেন না। আর এই ধরনের লোকদেরকে কেউ সাহায্য করতে পারে না।’ সূরা আন্ নাহল \ ৩৭
وَعَمِلَ صَالِحًا. অর্থ : ‘এবং আল ‘আমালুছ ছালিহ করে।’
এই কথাটির মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন সূক্ষ্মভাবে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, দা‘য়ী ইলাল্লাহর মুখের কথা ও কাজে বৈপরীত্য থাকতে পারে না।
প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্র, প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেন এবং প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ মুখে উচ্চারিত সুন্দর কথাগুলোর প্রভাব বিনষ্ট করে দেয়।
وَقَالَ اِنَّنِىْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ. অর্থ : ‘এবং বলে : অবশ্যই আমি মুসলিমদের একজন।’
এই কথাটির মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূল হোক, কিংবা প্রতিকূল, প্রকৃত মুমিনকে সর্বাবস্থায় তার মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।
৫ম আয়াত✅وَ لَا تَسْتَوِی الْحَسَنَةُ وَ لَا السَّیِّئَةُؕ اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ فَاِذَا الَّذِیْ بَیْنَكَ وَ بَیْنَهٗ عَدَاوَةٌ كَاَنَّهٗ وَلِیٌّ حَمِیْمٌ
হে নবী, সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকী দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভাল। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে।
এ কথার অর্থও পুরোপুরি বুঝার জন্য যে অবস্থায় নবী ﷺ কে ও তাঁর মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তা বিবেচনা থাকা দরকার। তখন অবস্থা ছিল এই যে, চরম হঠকারিতার এবং আক্রমণাত্মক বিরোধিতার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের মোকাবিলা করা হচ্ছিলো যেখানে নৈতিকতা, মানবতা এবং ভদ্রতার সমস্ত সীমা লংঘন করা হয়েছিলো। নবী ﷺ ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে সব রকমের মিথ্যা আরোপ করা হচ্ছিলো। তাঁকে বদনাম করা এবং তাঁর সম্পর্কে লোকের মনে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য সব রকমের দুষ্টবুদ্ধি ও কূটকৌশল কাজে লাগানো হচ্ছিলো। তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকমের অপবাদ আরোপ করা হচ্ছিলো এবং শত্রুতামূলক প্রচারণার জন্য পুরো একদল লোক তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে যাচ্ছিলো। তাঁকে তাঁর সঙ্গীদেরকে সর্ব প্রকার কষ্ট দেয়া হচ্ছিলো। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাছাড়া তাঁর ইসলাম প্রচারের ধারাকে বাঁধাগ্রস্ত করার জন্য পরিকল্পনা মাফিক হৈ চৈ ও হট্টগোলকারী একদল লোককে সব সময় ওঁত পেতে থাকার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। যখনই তিনি ন্যায় ও সত্যের দাওয়াত দেয়ার জন্য কথা বলতে শুরু করবেন তখনই তারা শোরগোল করবে এবং কেউ তাঁর কথা শুনতে পাবে না। এটা এমনই একটা নিরুৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি ছিল যে, বাহ্যিকভাবে আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ বলে মনে হচ্ছিলো। বিরোধিতা নস্যাৎ করার জন্য সেই সময় নবীকে ﷺ এসব পন্থা বলে দেয়া হয়েছিলো।
প্রথম কথা বলা হয়েছে, সৎকর্ম ও দুষ্কর্ম সমান নয়। অর্থাৎ তোমাদের বিরোধীরা যত ভয়ানক তুফানই সৃষ্টি করুক না কেন এবং তার মোকাবিলায় নেকীকে যত অক্ষম ও অসহায়ই মনে হোক না কেন দুষ্কর্মের নিজের মধ্যেই এমন দুর্বলতা আছে যা শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যর্থ করে দেয়। কারণ, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ, ততক্ষণ পর্যন্ত তার স্বভাব প্রকৃতি দুষ্কর্মকে ঘৃণা না করে পারে না। দুষ্কর্মের সহযোগীই শুধু নয় তার ধ্বজাধারী পর্যন্ত মনে মনে জানে যে, সে মিথ্যাবাদী ও অত্যাচারী এবং সে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য হঠকারিতা করছে। এ জিনিসটি অন্যদের মনে তার প্রতি সম্মানবোধ সৃষ্টি করা তো দূরের কথা নিজের কাছেই তাকে খাটো করে দেয়। এভাবে তার নিজের মনের মধ্যেই এক চোর জন্ম নেয়। শত্রুতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এই চোর ভেতর থেকেই তার সংকল্প ও মনোবলের ওপর সঙ্গোপনে হানা দিতে থাকে। এই দুষ্কর্মের মোকাবিলায় যে সৎকর্মকে সম্পূর্ণ অক্ষম ও অসহায় বলে মনে হয় তা যদি ত্রুমাগত তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত সে-ই বিজয়ী হয়। কারণ, প্রথমত সৎকর্ম নিজেই একটি শক্তি যা হৃদয়-মনকে জয় করে এবং ব্যক্তি যতই শত্রুতাভাবাপন্ন হোক না কেন সে নিজের মনে তার জন্য সম্মানবোধ না করে পারে না। তাছাড়া নেকী ও দুষ্কর্ম যখন সামনা-সামনি সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং উভয়ের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি উন্মোচিত হয় এমন পরিস্থিতিতে কিছুকাল সংঘাতে লিপ্ত থাকার পর এমন খুব কম লোকই থাকতে পারে যারা দুষ্কর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণ করবে না এবং সৎকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবে না।
দ্বিতীয় কথাটি বলা হয়েছে এই যে, দুষ্কর্মের মোকাবিলা শুধুমাত্র সৎকর্ম দিয়ে নয়, অনেক উচ্চমানের সৎকর্ম দিয়ে করো। অর্থাৎ কেউ যদি তোমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে আর তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও তাহলে শুধু সৎকর্ম। উন্নত পর্যায়ের সৎকর্ম হচ্ছে, যে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবে সুযোগ পেলে তুমি তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করো।
এর সুফল বলা হয়েছে এই যে, জঘণ্যতম শত্রুও এভাবে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। কারণ, এটিই মানুষের প্রকৃতি। আপনি যদি গালির জবাব না দিয়ে চুপ থাকেন তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি নেকী বা সৎকর্ম। অবশ্য তা গালিদাতার মুখ বন্ধ করতে পারবে না। কিন্তু গালির জবাবে আপনি যদি তার কল্যাণ কামনা করেন তাহলে চরম নির্লজ্জ শত্রুও লজ্জিত হবে এবং আর কখনো আপনার বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলার জন্য মুখ খোলা তার জন্য কঠিন হবে। একজন লোক আপনার ক্ষতি করার কোন সুযোগই হাত ছাড়া হতে দেয় না। আপনি যদি তার অত্যাচার বরদাশত করে যেতে থাকেন তাহলে সে হয়তো তার দুস্কর্মের ব্যাপারে আরো সাহসী হয়ে উঠবে। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তখন যদি আপনি তাকে রক্ষা করেন তাহলে আপনার একান্ত অনুগত হয়ে যাবে। কারণ, ঐ সুকৃতির মোকাবিলায় কোন দুস্কৃতিই টিকে থাকতে পারে না। তা সত্ত্বেও এই সাধারণ নিয়মকে এ অর্থে গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, উন্নত পর্যায়ের সৎকর্মের মাধ্যমে সব রকমের শত্রুর অনিবার্যরূপে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন জঘন্য মনের মানুষও আছে যে, তার অত্যাচার ক্ষমা করা ও দুষ্কৃতির জবাব অনুকম্পা ও সুকৃতির মাধ্যমে দেয়ার ব্যাপারে আপনি যতই তৎপর হোন না কেন তার বিচ্ছুর ন্যায় বিষাক্ত হুলের দংশনে কখনো ভাটা পড়বে না। তবে এ ধরনের মূর্তিমান খারাপ মানুষ প্রায় ততটাই বিরল যতটা বিরল মূর্তিমান ভাল মানুষ।
৬ষ্ঠ আয়াত✅وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا الَّذِیْنَ صَبَرُوْاۚ وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا ذُوْ حَظٍّ عَظِیْمٍ
وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا الَّذِیْنَ صَبَرُوْاۚ ধৈর্য্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না।
অর্থাৎ এটা অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হলেও তা কাজে লাগানো কোন ছেলেখেলা নয়। এজন্য দরকার সাহসী লোকের। এজন্য দরকার দৃঢ় সংকল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং চরম আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। সাময়িকভাবে কেউ কোন দুষ্কর্মের মোকাবিলায় সৎকর্ম করতে পারে। এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে এমন সব বাতিলপন্থী দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ন্যায় সত্যের জন্য লড়াই করতে হয় যারা নৈতিকতার যে কোন সীমালঙ্ঘন করতে দ্বিধা করে না এবং শক্তি ও ক্ষমতার নেশায় চূর হয়ে আছে সেখানে দুষ্কর্মের মোকাবিলা সৎকর্ম দিয়ে করে যাওয়া তাও আবার উচ্চ মাত্রার সৎকর্ম দিয়ে এবং একবারও নিয়ন্ত্রণের বাগডোর হাত ছাড়া হতে না দেয়া কোন সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কেবল সেই ব্যক্তিই এ কাজ করতে পারে যে বুঝে শুনে ন্যায় ও সত্যকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে, যে তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার শক্তির অনুগত করে নিয়েছে এবং যার মধ্যে নেকী ও সততা এমন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, বিরোধীদের কোন অপকর্ম ও নোংরামি তাকে তার উচ্চাসন থেকে নীচে নামিয়ে আনতে সফল হতে পারেনা।
وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا ذُوْ حَظٍّ عَظِیْمٍ অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।
এটা প্রকৃতির বিধান। অত্যন্ত উচু মর্যাদার মানুষই কেবল এসব গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি এসব গুণাবলীর অধিকারী হয় দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে সাফল্যের মনযিলে মকসুদে পৌঁছা থেকে বিরত রাখতে পারে না। নীচ প্রকৃতির মানুষ তাদের হীন চক্রান্ত, জঘন্য কৌশল এবং কুৎসিত আচরণ দ্বারা তাকে পরাস্ত করবে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
৭ম আয়াত ✅وَ اِمَّا یَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّیْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ
وَ اِمَّا یَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّیْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِؕ যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা আঁচ করতে পারো তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো
শয়তান যখন দেখে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দ্বারা হীনতার এবং সুকৃতি দ্বারা দুষ্কৃতির মোকাবিলা করা হচ্ছে তখন সে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। সে চায় কোনভাবে একবারের জন্য হলেও হকের জন্য সংগ্রামকারী বিশেষ করে তাদের বিশিষ্ট লোকজন ও নেতৃবৃন্দের দ্বারা এমন কোন ত্রুটি সংঘটিত করিয়ে দেয়া যাতে সাধারণ মানুষকে বলা যায়, দেখুন খারাপ কাজ এক তরফা হচ্ছে না। এক পক্ষ থেকে নীচ ও জঘন্য কাজ করা হচ্ছে বটে, কিন্তু অপর পক্ষের লোকেরাও খুব একটা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ নয়, তারাও তো অমুক হীন আচরণ করেছে। এক পক্ষের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি এবং অপর পক্ষের জবাবী তৎপরতার মধ্যে ইনসাফের সাথে তুলনামূলক বিচারের যোগ্যতা সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকে না। যতক্ষণ তারা দেখে বিরোধীরা সব রকমের জঘন্য আচরণ করছে কিন্তু এই লোকগুলো ভদ্রতা ও শিষ্টচার এবং মর্যাদা নেকী ও সত্যবাদীতার পথ থেকে বিন্দুমাত্রও দূরে সরে যাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর তার গভীর প্রভাব পড়তে থাকে। কিন্তু যদি কোথাও তাদের পক্ষ থেকে কোন অযৌক্তিক বা তাদের মর্যাদার পরিপন্থী আচরণ হয়ে যায়, তা কোন বড় জুলুমের প্রতিবাদে হলেও তাদের দৃষ্টিতে তারা উভয়েই সমান হয়ে যায় এবং বিরোধীরাও একটি শক্ত কথার জবাব হঠকারিতার সাহায্যে দেয়ার অজুহাত পেয়ে যায়। এ কারণে বলা হয়েছে, শয়তানের প্রতারণার ব্যাপারে সাবধান থাকো। সে অত্যন্ত দরদী ও মঙ্গলকামী সেজে এই বলে তোমাদেরকে উত্তেজিত করবে যে, অমুক অত্যাচার কখনো বরদাশত করা উচিত নয়, অমুক কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত এবং এই আক্রমনের জবাবে লড়াই করা উচিত। তা না হলে তোমাদেরকে কাপুরুষ মনে করা হবে এবং তোমাদের আদৌ কোন প্রভাব থাকবে না। এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমরা যখন নিজেদের মধ্যে কোন অযথা উত্তেজনা অনুভব করবে তখন সাবধান হয়ে যাও। কারণ, তা শয়তানের প্ররোচনা। সে তোমাদের উত্তেজিত করে কোন ভুল সংঘটিত করাতে চায়। সাবধান হয়ে যাওয়ার পর মনে করো না আমি আমার মেজাজকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখছি, শয়তান আমাকে দিয়ে কোন ত্রুটি করাতে পারবে না। নিজের এই ইচ্ছা শক্তির বিভ্রম হবে শয়তানের আরেকটি বেশী ভয়ংকর হাতিয়ার। এর চেয়ে বরং আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত। কারণ তিনি যদি তাওফীক দান করেন ও রক্ষা করেন তবেই মানুষ ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা পেতে পারে।
ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে যে ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন সেটি এ বিষয়ের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি বলেনঃ নবী ﷺ এর সামনে একবার এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকলো। হযরত আবু বকর চুপচাপ তার গালি শুনতে থাকলেন আর তাঁর দিকে চেয়ে নবী ﷺ মুচকি হাসতে থাকলেন। অবশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন এবং জবাবে তিনিও তাকে একটি কঠোর কথা বলে ফেললেন। তার মুখ থেকে সে কথাটি বের হওয়া মাত্র নবীর ﷺ ওপর চরম বিরক্তি ভাব ছেয়ে গেল এবং ক্রমে তা তাঁর পবিত্র চেহারায় ফুট উঠতে থাকলো। তিনি তখনই উঠে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরও উঠে তাঁকে অনুসরণ করলেন এবং পথিমধ্যেই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি? সে যখন আমাকে গালি দিচ্ছিলো তখন আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন। কিন্তু যখনই আমি তাকে জবাব দিলাম তখনই আপনি অসন্তুষ্ট হলেন? নবী ﷺ বললেনঃ তুমি যতক্ষন চুপচাপ ছিলে ততক্ষন একজন ফেরেশতা তোমার সাথে ছিল এবং তোমার পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু যখন তুমি নিজেই জবাব দিলে তখন ফেরেশতার স্থানটি শয়তান দখল করে নিল। আমি তো শয়তানের সাথে বসতে পারি না।
اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ তিনি সব কিছু শোনেন এবং জানেন।
বিরোধিতার তুফানের মুখে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার পর যে জিনিসটি মু’মিনের হৃদয়ে ধৈর্য্য, প্রশান্তি ও তৃপ্তির গভীর শীতলতা সৃষ্টি করে তা এই বিশ্বাস যে আল্লাহ বিষয়টি সম্পর্কে অনবহিত নন। আমরা যা করছি তাও তিনি জানেন এবং আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে তাও তিনি জানেন। আমাদের ও আমাদের বিরোধীদের সব কথাই তিনি শুনছেন এবং উভয়ের কর্মনীতি যা কিছুই হোক না কেন তা তিনি দেখছেন। এই আস্থার কারণেই মু’মিন বান্দা নিজের এবং ন্যায় ও সত্যের দুশমনের ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত হয়ে যান।
★শিক্ষাঃ
আল্লাহকে নিজেদের রব বলে ঘোষণা দিয়ে যারা নিজেদের চিন্তা ও কর্মে তার প্রতিফলন ঘটায়, বিশেষ করে ‘আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহর-র’ কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং প্রতিকূলতাসত্বেও মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে মাথা উচুঁ করে দাঁড়ায়, সম্মানিত ফেরেশতাগণ হন তাদের বন্ধু এবং আখিরাতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন তাদেরকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করবেন।
১। আমরা আল্লাহকে আমাদের রব বলে ঘোষণা দেবো, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি রহমতের ফেরেশতা নেমে এসে আমাদেরকে অভয় দান করবে এবং বেহেশতের সুসংবাদ দেবে। সেই ফেরেশতা দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে প্রত্যেক কাজে আমাদেরকে সহায়তা দেবে ।
২। আমরা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকবো, সৎ কাজ করবো এবং নিজকে আত্মসমর্পণকারী হিসেবে ঘোষণা দেবো ।
৩। সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। সৎ কাজ দ্বারা অসৎ কাজের মুকাবিলা করবো, তাহলে প্রাণের দুশমনও অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে ।
৪ । শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু । ঈমানদারগণ নিজেদের মধ্যে শয়তানের প্ররোচনা টের পেলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে ।
মাশা-আল্লাহ্ 💟
ReplyDelete