দারসুল কোরআন//সূরা নিসা, আয়াত (৭১-৭৬)

দারসুল কোরআন
সূরা নিসা, আয়াত (৭১-৭৬)

★আরবী ইবারত ও সরল বাংলা অনুবাদঃ-

ﺑِﺴْﻢِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَٰﻦِ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴﻢِ

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ خُذُواْ حِذْرَكُمْ فَٱنفِرُواْ ثُبَاتٍ أَوِ ٱنفِرُواْ جَمِيعًا

(৭১) হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সতর্কতা অবলম্বন কর, অতঃপর হয় দলে দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হও অথবা এক সঙ্গে সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হও।

وَإِنَّ مِنكُمْ لَمَن لَّيُبَطِّئَنَّ فَإِنْ أَصَـٰبَتْكُم مُّصِيبَةٌ قَالَ قَدْ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَىَّ إِذْ لَمْ أَكُن مَّعَهُمْ شَهِيدًا

(৭২) আর তোমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যে পিছনে থাকবেই। অতঃপর তোমাদের কোন বিপদ হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম না।

وَلَئِنْ أَصَـٰبَكُمْ فَضْلٌ مِّنَ ٱللَّهِ لَيَقُولَنَّ كَأَن لَّمْ تَكُنۢ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُۥ مَوَدَّةٌ يَـٰلَيْتَنِى كُنتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا

(৭৩) আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ হয়, তাহলে সে অবশ্যই বলবে, ‘হায়! যদি আমি তাদের সাথে থাকতাম, তাহলে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম।’যেন তোমাদের ও তার মধ্যে কোন সদ্ভাবই ছিল না।

فَلْيُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يَشْرُونَ ٱلْحَيَوٲةَ ٱلدُّنْيَا بِٱلْأَخِرَةِ‌ۚ وَمَن يُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

(৭৪) অতএব যারা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবনকে বিক্রয় করে তাদের আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা উচিত। বস্তুতঃ যে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে, অতঃপর সে নিহত হবে অথবা বিজয়ী, আমি তাকে শীঘ্রই মহা পুরস্কার দান করব।

وَمَا لَكُمْ لَا تُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلْوِلْدَٲنِ ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَآ أَخْرِجْنَا مِنْ هَـٰذِهِ ٱلْقَرْيَةِ ٱلظَّالِمِ أَهْلُهَا وَٱجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيًّا وَٱجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيرًا

(৭৫) তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের (উদ্ধারের) জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! অত্যাচারী অধিবাসীদের এই নগর হতে আমাদেরকে বাহির করে অন্যত্র নিয়ে যাও এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের সহায় নিযুক্ত কর।

ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ‌ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱلطَّـٰغُوتِ فَقَـٰتِلُوٓاْ أَوْلِيَآءَ ٱلشَّيْطَـٰنِ‌ۖ إِنَّ كَيْدَ ٱلشَّيْطَـٰنِ كَانَ ضَعِيفًا

 (৭৬) যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে এবং যারা অবিশ্বাসী তারা তাগূতের পথে সংগাম করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর। নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।

★সূরা পরিচিতি:- 

সূরা আন নিসা (আরবি ভাষায়: سورة النساء, Sūratu an-Nisā, অর্থ "মহিলা") মহাগ্রন্থ আল কুরআনের চতুর্থ সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ১৭৬টি এবং এর রূকুর সংখ্যা ২৪টি। আন নিসা সূরাটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরাতে মুসলিমদের জীবন পরিচালনা ও কীভাবে একতাবদ্ধ থাকতে হবে সে সম্পর্কে বলা আছে।
শ্রেণী : মাদানী
নামের অর্থ : নারী
পরিসংখ্যান
সূরার ক্রম  :
আয়াতের সংখ্যা : ১৭৬
পারার ক্রম : ৪ পারা (১-২৩ আয়াত)
৫ পারা (২৪-১৪৭ আয়াত)
৬ পারা (১৪৮-১৭৬ আয়াত)
রুকুর সংখ্যা : ২৪
সিজদাহ্‌র সংখ্যা : নেই
← পূর্ববর্তী সূরা : সূরা আল-ইমরান
পরবর্তী সূরা → : সূরা মায়িদাহ

★ নামকরণঃ

এ সূরার প্রথম আয়াতে বর্ণিত

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً

এর মধ্যকার النِّسَاءٌ শব্দ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
অথবা এই সূরার মধ্যে আল্লাহ তাআলা সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কের সীমা, নারীদের উত্তরাধিকার (মিরাস) বণ্টনের নিয়ম-কানুনসহ নারীসমাজের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় বর্ণনা করেছেন যার কারণে এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে ‘সূরা নিসা’।

★নাযিলের সময়কালঃ

সূরা নিসা মাদানী সুরা। সম্ভবত তৃতীয় হিজরির শেষ দিক থেকে শুরু করে চতুর্থ হিজরির শেষ দিকে বা পঞ্চম হিজরির প্রথম দিকের সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অংশে নাজিল হয়। নবী (সা:) এর সামনে সে সময় যেসব কাজ ছিল তা তিনটি বড় বড় ভাগে ভাগ করা যায়।

১. সবে গঠিত ইসলামী সমাজ সংগঠনের বিকাশ সাধন। জাহেলিয়াতের পুরাতন পদ্ধতির নির্মূল ঘটিয়ে নৈতিকতা, তমদ্দুন, সমাজরীতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন নীতি-নিয়মের প্রচলনের তৎপরতা এগিয়ে চলছিল।
২. আরবের মুশরিক, ইহুদি ও মুনাফিকদের সম্মিলিত সংস্কার বিরোধী শক্তির সাথে ইসলামের যে ঘোরতর সংঘাত চলে আসছিল তা জারি রাখা।
৩. এ বিরোধী শক্তিগুলোর সকল বাধা উপেক্ষা করে ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে এবং ইসলামকে বিজয়ীর আসনে অধিষ্ঠিত করা। এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে যতগুলো ভাষণ অবতীর্ণ হয়, তা সবই এই তিনটি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত।

★ শানে নুযুলঃ

হিজরতের পর মক্কায় থেকে যাওয়া অবশিষ্ট মুসলিমগণ, বিশেষ করে বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলা এবং ছোট শিশুরা, যারা শারীরিক বা আর্থিক দুর্বলতার কারণে হিজরত করতে পারেননি।

মক্কার কাফেররা তাদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতো এবং তাদেরকে হিজরত করতেও বাধা দিত।

সে জন্য কাফেরদের যুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এ সকল মুমিনগণ আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দু’আ করতেন। তখন আল্লাহ তায়ালা আলোচ্য আয়াতসমূহ নাযিল করেন।


★আলোচ্য বিষয়: 

সূরাটির নামকরণ এর দিকে লক্ষ্য করে যদিও ‘নিসা’ তথা নারীদের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় । তথাপি এই সূরায় নারীদের প্রসঙ্গ ছাড়াও ইসলামী সমাজের আইন কানুন, বিয়ে-শাদি, ইয়াতিমের সম্পদের অধিকার, মীরাসের বন্টন বিধি, লেনদেন পদ্ধতি এবং ঘরোয়া বিবাদ মেটানোর পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে। অপরাধের শাস্তি বিধান, মদ পান এবং মানবতার মুক্তির জন্য জিহাদের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সব শেষে ইহুদি, খ্রীষ্টান ও মুশরিকদের দীন ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।

১. পরিবার গঠনের নীতিমালা,
২. সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সীমা নির্দেশ,
৩. ঘরোয়া বিবাদ মিটানোর পদ্ধতি,
৪. এতিমের অধিকার নির্দিষ্ট করা,
৫. মিরাস (উত্তরাধিকার) বণ্টনের নিয়ম-কানুন,
৬. অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশুদ্ধির নিয়ম-কানুন (জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি ও সুদমুক্ত ব্যবসা)
৭. অপরাধ ও দ্বন্ডবিধি,
৮. তাহারাত ও পাক-পবিত্রতার বিধিবিধান,
৯. মদ্য পানের ওপর বিধি নিষেধ,
১০. মুসলমানদের বিরোধী শক্তির মোকাবেলায় উদ্বুদ্ধকরণ,
১১. ঈমান ও নিফাকের পার্থক্য ও মুনাফিকদের কর্মনীতির সমালোচনা,
১২. মুসলমানদের উন্নত নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দান,
১৩. ইহুদি-খ্রিষ্টান ও মুশরিকদের ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা-বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র, নীতি ও কর্মকান্ডের সমালোচনা করে সত্য দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করাই মূলত এই সূরার আলোচ্য বিষয়।



★ সংক্ষিপ্ত তাফসীরঃ- 

৭১ নং আয়াতের তাফসীরঃ-

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ خُذُواْ حِذْرَكُمْ فَٱنفِرُواْ ثُبَاتٍ أَوِ ٱنفِرُواْ جَمِيعًا

হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সতর্কতা অবলম্বন কর,[1] অতঃপর হয় দলেদলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হও অথবা এক সঙ্গে সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হও।   

[1] ﺣِﺬْﺭَﻛُﻢْঅর্থাৎ, অস্ত্র-শস্ত্র, যুদ্ধ-সামগ্রী এবং অন্য উপকরণাদি দ্বারা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ কর।

আয়াতের প্রথমাংশে জিহাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং আয়াতের দ্বিতীয় অংশে জিহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বেশকিছু শিক্ষা রয়েছে – 

(১) কোন ব্যাপারে বাহ্যিক উপকরণ অবলম্বন করা তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার পরিপন্থী নয়। 

(২) অস্ত্র সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হলেও এমন প্রতিশ্রুতি কিন্তু দেয়া হয়নি যে, এ অস্ত্রের কারণে তোমরা নিশ্চিতভাবেই নিরাপদ হতে পারবে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বাহ্যিক উপকরণ অবলম্বন করাটা মূলতঃ মানসিক স্বস্তি লাভের জন্যই হয়ে থাকে। 

(৩) এ আয়াতে প্রথমে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ অতঃপর জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সুশৃংখল নিয়ম বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যখন জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে, তখন একা একা বাহির হবেনা, বরং ছোট ছোট দলে বাহির হবে কিংবা (সম্মিলিত) বড় সৈন্যদল নিয়ে বাহির হবে। তার কারণ, একা একা যুদ্ধ করতে গেলে ক্ষতির আশংকা রয়েছে। শক্ররা এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মোটেই শৈথিল্য করে না। (তাফসীরে জাকারিয়া)


৭২ নং আয়াতের তাফসীরঃ-

وَإِنَّ مِنكُمْ لَمَن لَّيُبَطِّئَنَّ فَإِنْ أَصَـٰبَتْكُم مُّصِيبَةٌ قَالَ قَدْ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَىَّ إِذْ لَمْ أَكُن مَّعَهُمْ شَهِيدًا

আর তোমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যে পিছনে থাকবেই।[2] অতঃপর তোমাদের কোন বিপদ হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম না।’

[2] এখানে মুনাফিকদের কথা বলা হচ্ছে। ‘পিছনে থাকবেই’-এর অর্থ, জিহাদে না গিয়ে পিছনে থেকে যাবেই।  -তাফসীরে আহসানুল বায়ান।


৭৩ নং আয়াতের তাফসীরঃ-

وَلَئِنْ أَصَـٰبَكُمْ فَضْلٌ مِّنَ ٱللَّهِ لَيَقُولَنَّ كَأَن لَّمْ تَكُنۢ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُۥ مَوَدَّةٌ يَـٰلَيْتَنِى كُنتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا

আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ হয়,[3] তাহলে সে অবশ্যই বলবে, ‘হায়! যদি আমি তাদের সাথে থাকতাম, তাহলে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম।’[4] যেন তোমাদের ও তার মধ্যে কোন সদ্ভাবই ছিল না। [5]


[3] অর্থাৎ, জিহাদে বিজয় এবং গনীমতের মাল লাভ হয়।

[4] অর্থাৎ, গনীমতের মালের অংশ পাওয়া যেত, যা দুনিয়াদার মানুষের মূল লক্ষ্য।

[5] অর্থাৎ, যেন সে তোমাদের ধর্মাবলম্বিদের কেউ নয়; বরং সে যেন অপরিচিত পর কেউ।

মুজাহিদ বলেন, এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে যাদেরকে বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে মুনাফিক। যারা সাহাবাদের সাথে মিশে থাকত। [আত-তাফসীরুস সহীহ] যুদ্ধের ঘোষণা শোনার সথে সাথেই তাদের মধ্যে গড়িমসি শুরু হত। এরপর যদি মুসলিমদের কোন বিপদ হতো, তখন তারা বলত যে, তাদের সাথে না থাকাটা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ অবস্থায় তারা খুশীও প্রকাশ করত। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। [সূরা আলে-ইমরান: ১২০]

“আপনার মংগল হলে তা ওদেরকে কষ্ট দেয় এবং আপনার বিপদ ঘটলে ওরা বলে, ‘আমরা তো আগেই আমাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম এবং ওরা উৎফুল্ল চিত্তে সরে পড়ে।” [আত-তাওবাহ: ৫০] পক্ষান্তরে যখন মুসলিমদের কোন বিজয়ের কথা শুনত, তখন তারা বোল পাল্টিয়ে ফেলত যাতে করে যুদ্ধলন্দ সম্পদে ভাগ বসাতে পারে। যদিও মুসলিমদের বিজয় তাদের মনের জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। [আদওয়াউল বায়ান]

তাফসীরে জাকারিয়া


৭৪ নং আয়াতের তাফসীরঃ-

فَلْيُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يَشْرُونَ ٱلْحَيَوٲةَ ٱلدُّنْيَا بِٱلْأَخِرَةِ‌ۚ وَمَن يُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

“পরকালের বিনিময়ে যেসব লোক দুনিয়ার জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে তাদের (সেসব সৌভাগ্যবানের) উচিত আল্লাহর পথে লড়াই সংগ্রাম করা। কারণ, যে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করবে/লড়বে এবং জীবন বিলিয়ে দেবে (মারা যাবে) অথবা বিজয়ী হবে তাকে অচিরেই আমি বিরাট পুরস্কার দেব।”
ব্যাখ্যা : পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে আল্লাহর পথে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়ার কারণ এই যে, ইসলামে আল্লাহর পথে ছাড়া অন্য কোনো রকমের যুদ্ধ বা লড়াইয়ের অনুমতি নেই।

# সম্পদ লাভের জন্য।
# আধিপত্য ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য।
# ব্যক্তিগত ও জাতিগত গৌরবের জন্য যে লড়াই করা হয় ইসলাম বা আল-কুরআন তার অনুমোদন দেয় না।

ইসলাম শুধুমাত্র আল্লাহর পথে তথা জমিনের বুকে আল্লাহর কালিমা সর্বোচ্চে তুলে ধরা এবং আল্লাহর বিধানকে গোটা জীবনের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা, মানবসমাজে আল্লাহর বিধানের মাধ্যমে সুবিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের/লড়াইয়ের অনুমতি দেয়। এ লড়াইয়ে নিহত হলে শহীদের মর্যাদা লাভ এবং বিজয়ী হলে গাজি। 

মু’মিনের তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত, যারা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবনকে ক্রয় করে। অর্থাৎ, যারা দুনিয়ার সামান্য মালের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে দিয়েছে। এ থেকে মুনাফিক এবং কাফেরদেরকে বুঝানো হয়েছে। (ইবনে কাসীর এই অর্থই বর্ণনা করেছেন।) -তাফসীরে আহসানুল বায়ান।


৭৫ নং আয়াতের তাফসীরঃ-

وَمَا لَكُمْ لَا تُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلْوِلْدَٲنِ ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَآ أَخْرِجْنَا مِنْ هَـٰذِهِ ٱلْقَرْيَةِ ٱلظَّالِمِ أَهْلُهَا وَٱجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيًّا وَٱجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيرًا

তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের (উদ্ধারের) জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! অত্যাচারী অধিবাসীদের এই নগর হতে আমাদেরকে বাহির করে অন্যত্র নিয়ে যাও এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের সহায় নিযুক্ত কর।’[7]


[7] ‘অত্যাচারী অধিবাসীদের এই নগর’ বলতে (অবতীর্ণ হওয়ার দিক দিয়ে) মক্কাকে বুঝানো হয়েছে। হিজরতের পর সেখানে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট মুসলিমগণ --- বিশেষ করে বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলা এবং ছোট শিশুরা কাফেরদের যুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য দু’আ করতেন। তাই মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে এই বলে সতর্ক করলেন যে, তোমরা ঐ অসহায়-দুর্বল মুসলিমদেরকে কাফেরদের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জিহাদ কেন কর না? এই আয়াতকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে আলেমগণ বলেছেন, মুসলিমরা যদি এই ধরনের যুলুম-অত্যাচারের শিকার হয় এবং কাফেরদের বেষ্টনে অবরুদ্ধ থাকে, তাহলে তাদেরকে কাফেরদের যুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জিহাদ করা অন্য মুসলিমদের উপর ফরয হয়ে যায়। এটা হল জিহাদের দ্বিতীয় প্রকার। আর প্রথম প্রকার হল, আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা, প্রচার-প্রসার এবং তাকে জয়যুক্ত করার জন্য জিহাদ করা। এর উল্লেখ পূর্বের আয়াতে এবং পরের আয়াতে রয়েছে। 

মক্কা নগরীতে এমন কিছু দুর্বল মুসলিম রয়ে গিয়েছিলেন, যারা দৈহিক দুর্বলতা এবং আর্থিক দৈন্যের কারণে হিজরত করতে পারছিলেন না। পরে কাফেররাও তাদেরকে হিজরত করতে বাধাদান করেছিল এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে আরম্ভ করেছিল, যাতে তারা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। যেমন ইবন আব্বাস ও তার মাতা, সালামা ইবন হিশাম, ওলীদ ইবন ওলীদ, আবু জান্দাল ইবন সাহল প্রমূখ। এসব সাহাবী নিজেদের ঈমানী বলিষ্ঠতার দরুন কাফেরদের অসহনীয় উৎপীড়ন সহ্য করেও ঈমানের উপর স্থির থাকেন। অবশ্য তারা এসব অত্যাচার উৎপীড়ন থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য বরাবরই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দো’আ করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলা তাদের সে প্রার্থনা মঞ্জুর করে নেন এবং মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেন যাতে তারা জিহাদের মাধ্যমে সেই নিপীড়িতদেরকে কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি ও আমার মা অসহায়দের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। [বুখারী ৪৫৮৭]

এ আয়াতে মুমিনরা আল্লাহ্ তা'আলার দরবারে দুটি বিষয়ে দোআ করেছিলেন। একটি হলো এই যে, আমাদিগকে এই (মক্কা) নগরী থেকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করুন এবং দ্বিতীয়টি হলো, আমাদের জন্য কোন সহায় বা সাহায্যকারী পাঠান। আল্লাহ তাদের দুটি প্রার্থনাই কবুল করে নিয়েছিলেন। তা এভাবে যে, কিছু লোককে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, যাতে তাদের প্রথম প্রার্থনাটি পূরণ হয়েছিল। অবশ্য কোন কোন লোক সেখানেই রয়ে যান এবং বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাব ইবন উসায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে সেসব লোকের মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। অতঃপর তিনি এসব উৎপীড়িতদেরকে অত্যাচারীদের উৎপীড়ন-অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন। আর এভাবেই পূর্ণ হয় তাদের দ্বিতীয় প্রার্থনাটি। আয়াতে বলা হয়েছে যে, জিহাদের নির্দেশ দানের পিছনে একটি কারণ ছিল সে সমস্ত অসহায় দুর্বল নারী-পুরুষের প্রার্থনা। মুসলিমগণকে জিহাদ করার নির্দেশ দানের মাধ্যমে সে প্রার্থনা মঞ্জুরীর কথাই ঘোষণা করা হয়েছে। (তাফসীরে জাকারিয়া)


৭৬ নং আয়াতের তাফসীরঃ-

ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ‌ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱلطَّـٰغُوتِ فَقَـٰتِلُوٓاْ أَوْلِيَآءَ ٱلشَّيْطَـٰنِ‌ۖ إِنَّ كَيْدَ ٱلشَّيْطَـٰنِ كَانَ ضَعِيفًا

যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে এবং যারা অবিশ্বাসী তারা তাগূতের পথে সংগাম করে। [8] সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর। নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।[9]


[8] কাফের এবং মু’মিন উভয়েরই যুদ্ধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু উভয়ের যুদ্ধের লক্ষ্যের মধ্যে বিরাট তফাৎ। মু’মিন তো জিহাদ করে আল্লাহর জন্য, কেবল দুনিয়ার স্বার্থে অথবা রাজ্য জয়ের প্রবৃত্তি নিয়ে নয়। পক্ষান্তরে কাফেরের লক্ষ্য হয় কেবল এই দুনিয়ার স্বার্থ অর্জন।

[9] মু’মিনদেরকে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে যে, ‘তাগূতী’ বা শয়তানী স্বার্থ অর্জনের জন্য যে চক্রান্ত করা হয়, তা হয় একান্ত দুর্বল। তাদের বাহ্যিক উপকরণাদির প্রাচুর্য এবং সংখ্যাধিক্যকে ভয় করো না। তোমাদের ঈমানী শক্তি এবং জিহাদের উদ্যমের সামনে শয়তানের এই দুর্বল চক্রান্ত টিকবে না। (তাফসীরে আহসানুল বায়ান)


(০১) যারা মুমিন বা ঈমানদার তারা জিহাদ করে আল্লাহর পথে। আর যারা কাফের তারা যুদ্ধ করে শয়তানের পথে। সুতরাং পরিপূর্ণ কোন মুমিন ব্যক্তি যখন যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, তখন তার সামনেই এ উদ্দেশ্য বিদ্যমান থাকে যে, আমি আল্লাহর পথেই এ কাজ করছি। তার নির্দেশ ও নিষেধকে বাস্তবায়নই আমার জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু এর বিপরীতে যারা কাফের তাদের বাসনা থাকে কুফরের প্রচলন, কুফরের বিজয় এবং পৈচাশিক শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা, যাতে করে বিশ্বময় কুফরী ও শির্কী বিস্তার লাভ করতে পারে। আর কুফরী ও শির্কী যেহেতু শয়তানের পথ, সুতরাং কাফেররা শয়তানের কাজেই সাহায্য করে থাকে।

(২)শয়তানের চক্রান্ত ও কলাকৌশল হয় দুর্বল। ফলে তা মুমিনের সামান্যতমও ক্ষতি করতে পারে না। অতএব মুসলিমগণকে শয়তানের বন্ধুবৰ্গ অর্থাৎ কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে কোন রকম দ্বিধা করা উচিত নয়। তার কারণ, তাদের সাহায্যকারী হলেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা। পক্ষান্তরে শয়তানের কলাকৌশল কাফেরদের কিছুই মঙ্গল সাধন করবে না। এ আয়াতে শয়তানের কলাকৌশলকে যে দুর্বল বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেজন্য আয়াতের মাধ্যমেই দু'টি শর্তের বিষয়ও প্রতীয়মান হয়। (এক) যে লোকের বিরুদ্ধে শয়তান কলাকৌশল অবলম্বন করবে, তাকে মুসলিম হতে হবে এবং (দুই) সে যে কাজে নিয়োজিত থাকবে, তা একান্তভাবেই আল্লাহর জন্য হতে হবে; কোন পার্থিব বস্তুর আকাঙ্খা কিংবা আত্মস্বার্থ প্রণোদিত হবে না। এ দু'টি শর্তের যেকোন একটির অবর্তমানে শয়তানের কলাকৌশল দুর্বল হয়ে পড়া অবশ্যম্ভাবী নয়। (তাফসীরে জাকারিয়া)


★ শিক্ষাঃ

১. সকল মুমিন সম্মিলিত ভাবে অথবা খন্ড খন্ড হলেও আল্লাহর পথে সংগ্রাম করতে হবে।

২. জিহাদ করতে হবে ঈমানের হক আদায়ের জন্য।

৩. জিহাদ করতে হবে অসহায় মানবতার মুক্তির জন্য। 

৪. জিহাদে অংশগ্রণ করে শহীদ হওয়া বা বিজয়ী হওয়া মুমিনের জন্য উভয়ই কল্যাণকর।

৫. ‘তাগূতী’ বা শয়তানী স্বার্থ অর্জনের জন্য যে চক্রান্ত করা হয়, তা হয় একান্ত দুর্বল।


মোহাম্মদ আবু হানিফ হেলাল 

-আহবায়ক, বাংলাদেশ মাদ্রাসা ছাত্রকল্যাণ পরিষদ, ফেনী জেলা।

No comments

Powered by Blogger.