রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য (أخلاق الرسول صـ وخصوصياته)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য (أخلاق الرسول صـ وخصوصياته)


তিনি ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও চমৎকার :

عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ ، قَالَ : " رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , فِي لَيْلَةٍ إِضْحِيَانٍ ، وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ حَمْرَاءُ ، فَجَعَلْتُ أَنْظُرُ إِلَيْهِ وَإِلَى الْقَمَرِ ، فَلَهُوَ عِنْدِي أَحْسَنُ مِنَ الْقَمَرِ " .

৭. জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। তখন আমি একবার তাঁর দিকে ও একবার চাদের দিকে তাকাতে থাকলাম। মনে হলো তিনি আমার কাছে পূর্ণিমার চাদের চেয়ে অধিকতর চমৎকার।

[মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৭৩৮৩; মারেফাতুস সাহাবা, হা/১৪৩৫; মিশকাত, হা/৫৭৯৪।]


عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ ، قَالَ : سَأَلَ رَجُلٌ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ : أَكَانَ وَجْهُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مثل السَّيْفِ ؟ قَالَ : " لا ، بَلْ مثل الْقَمَرِ " .

আবু ইসহাক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার বারা ইবনে আযিব (রাঃ) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা কি তরবারির ন্যায় ছিল? তিনি বললেন, না; বরং তা ছিল চাঁদের মতো।

[সহীহ বুখারী, হা/৩৫৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৫০১; দারেমী, হা/৬৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৬২৮৭।]


রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন সকল প্রকার মানবিক গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বন্ধু ও শত্রু সকলের মুখে সমভাবে তাঁর অনুপম চরিত্র মাধুর্যের প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে। কঠোর প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সম্মুখে অকুণ্ঠ চিত্তে তাঁর সততা, আমানতদারী ও সচ্চরিত্রতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন (বুখারী হা/৭)। আল্লাহপাক নিজেই স্বীয় রাসূলের প্রশংসায় বলেন,

 وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ 

‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (ক্বলম ৬৮/৪)। 

রাসূল (ছাঃ) বলেন,

 بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاَقِ 

‘আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য’।[ 1]. হাকেম হা/৪২২১; ছহীহাহ হা/৪৫, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

তাই দেখা যায়, নবুয়ত-পূর্ব জীবনে সকলের নিকটে প্রশংসিত হিসাবে তিনি ছিলেন ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত, আমানতদার) এবং নবুঅত পরবর্তী জীবনে চরম শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশেও তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতা, সাহস ও দৃঢ়চিত্ততা, দয়া ও সহমর্মিতা, পরোপকার ও পরমত সহিষ্ণুতা, লজ্জা ও ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি অনন্য গুণাবলীর জীবন্ত প্রতীক। আল্লাহ বলেন, 

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا 

‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)। 

তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুর্য ও অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্ণভাবে বর্ণনা করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ পূর্ণচন্দ্রের সৌন্দর্য বর্ণনা করা এবং খালি চোখে আকাশের তারকারাজি গণনা করা অসম্ভব। তবুও দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু চারিত্রিক নমুনা ও বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-


লজ্জাশীলতা (الحياء): 

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বদা দৃষ্টি অবনত রাখতেন। কখনোই অন্যের উপরে নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন না। তিনি কারো মুখের উপর কোন অপছন্দনীয় কথা বলতে লজ্জা পেতেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَشَدَّ حَيَاءً مِنَ الْعَذْرَاءِ فِى خِدْرِهَا وَكَانَ إِذَا كَرِهَ شَيْئًا عَرَفْنَاهُ فِى وَجْهِهِ- ‘তিনি পর্দানশীন কুমারী মেয়েদের চাইতে অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি কিছু অপছন্দ করতেন, তখন তাঁর চেহারা দেখে আমরা বুঝে নিতাম’।[19]. বুখারী হা/৬১০২; মুসলিম হা/২৩২০; মিশকাত হা/৫৮১৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ। 

কারো কোন মন্দ কাজ দেখলে সরাসরি তাকে মন্দ না বলে সাধারণভাবে নিষেধ করতেন, যাতে লোকটি লজ্জা না পায়। অথচ বিষয়টি বুঝতে পেরে সে নিজেই সংশোধন হয়ে যায়।

আল্লাহর রাসুল (স:) ছোটবেলা থেকেই তিনি ভীষণ লজ্জাশীল ছিলেন। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) নবুওয়াতের আগে কুরাইশদের সঙ্গে কাবাঘর সংস্কারের সময় পাথর তুলে দিচ্ছিলেন। তাঁর পরিধানে ছিল লুঙ্গি। তার চাচা আব্বাস (রা.) বললেন, ভাতিজা, লুঙ্গি খুলে কাঁধে পাথরের নিচে রাখলে ভালো হতো। জাবের (রা.) বলেন, তিনি লুঙ্গি খুলে কাঁধে রাখলেন এবং তৎক্ষণাৎ বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। এরপর তাঁকে আর কখনো নগ্ন অবস্থায় দেখা যায়নি। (বুখারি : ৩৬৪)


আজকে আমাদের সমাজে যুবকভাইরা হাটুর উপরে কাপড় পরে রাস্তায় হাটে। অথচ রাসুল (স:) বলেছেন- 

✪আবু দাউদ হাদীস নং ৪০১৫

عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَكْشِفْ فَخِذَكَ، وَلَا تَنْظُرْ إِلَى فَخِذِ حَيٍّ، وَلَا مَيِّتٍ قَالَ أَبُو دَاوُدَ: هَذَا الْحَدِيثُ فِيهِ نَكَارَةٌ

হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি নিজের উরুকে উম্মুক্ত করো না এবং কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির উরুর দিকে দৃষ্টি দিও না।’ (আবূ দাউদ: ৩১৪০/ ৪০১৫, ইবনে মাজাহ-১৪৬০, আহমাদ-১২৪৯)।


✪আবু দাউদ হাদীস নং ৪০১৪

عَنْ زُرْعَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ جَرْهَدٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: كَانَ جَرْهَدٌ هَذَا مِنْ أَصْحَابِ الصُّفَّةِ قَالَ: جَلَسَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَنَا وَفَخِذِي مُنْكَشِفَةٌ فَقَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الْفَخِذَ عَوْرَةٌ

যুর‘আহ ইবনু আব্দুর রাহমান ইবনু জারহাদ (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, এই ‘জারহাদ’ আসহাবে সুফফার অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট বসলেন, তখন আমার উরুদেশ অনাবৃত ছিলো। তিনি বললেনঃ তুমি কি জানো না যে, উরুদেশ গোপন অঙ্গ?(তিরমিজি-২৭৯৫/২৭৯৭/২৭৯৮, দারেমী- ২৬৯২, আহমাদ-১৫৯২৬/ ১৫৯২৮-১৫৯৩৩)


সত্যবাদিতা:


আমানতদারিতা:-

عَن أبي هُرَيْرَةَ قَالَ : بَيْنَمَا كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحَدِّثُ إِذْ جَاءَ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ : مَتَى السَّاعَةُ؟ قَالَ : إِذَا ضُيِّعَتِ الْأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ. قَالَ : كَيْفَ إِضَاعَتُهَا؟ قَالَ : إِذَا وُسِّدَ الْأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ، رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ-

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মজলিসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় তাঁর কাছে একজন বেদুঈন এল এবং প্রশ্ন করল, ক্বিয়ামত কবে হবে? উত্তরে তিনি বললেন, যখন আমানত বিনষ্ট হবে তখন ক্বিয়ামতের অপেক্ষা কর। লোকটি বলল, তা কিভাবে বিনষ্ট হবে? তিনি বললেন, যখন অযোগ্য লোকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে, তখন ক্বিয়ামতের অপেক্ষা কর’।[1]


নেতৃত্বের আমানত : 

এটি অত্যন্ত কঠিন আমানত। অনেক সময় এই আমানত রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন হয়। নানাবিধ অপবাদ ও জেল-যুলুম সহ্য করতে হয়। অতি ভক্তদের বাড়াবাড়ি ও বিরোধীদের চক্রান্ত সর্বদা তার সাথী হয়। মানুষ সর্বদা দায়িত্বশীলদের বিশেষ করে নেতাদের আমানতে সন্দেহ করে। এমনকি তারা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কেও ছাড়েনি। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, বদর যুদ্ধের গণীমতের মাল থেকে একটি লাল চাদর খোয়া গেলে কিছু লোক বলে,لَعَلَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخَذَهَا، সম্ভবতঃ রাসূল (ছাঃ) এটি নিয়েছেন’। তখন আয়াত নাযিল হয়,وَمَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَّغُلَّ، وَمَنْ يَّغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ- ‘কোন নবীর জন্য সমীচীন নয় খেয়ানত করা। যে ব্যক্তি যা খেয়ানত করে, তা নিয়ে সে ক্বিয়ামতের দিন হাযির হবে। অতঃপর প্রত্যেককে তার কৃতকর্ম অনুযায়ী তার ফলাফল পুরোপুরি দেওয়া হবে এবং তারা কেউ অত্যাচারিত হবে না’।[10]


ন্যায়বিচারক:

একবার কুরাইশ বংশীয় মাখজুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার হাত কর্তনের নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশমর্যাদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে তার একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) সুপারিশ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ অতঃপর লোকজনকে আহ্বান করে মহানবী (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে, এ জন্য যে তাদের কোনো সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তারা তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই তার হস্ত কর্তন করে দিতাম’ (বোখারি ও মুসলিম)।


বিনয় ও নম্রতা (التواضع والتذلل) : 

তিনি ছিলেন বিনয়ী ও নিরহংকার চরিত্রের মানুষ। তিনি সবাইকে মানুষ হিসাবে সমান জ্ঞান করতেন। উঁচু-নীচু ভেদাভেদ করতেন না। তাঁকে দেখে সম্মানার্থে দাঁড়াতে ছাহাবীগণকে নিষেধ করতেন।[20]. তিরমিযী হা/২৭৫৪; মিশকাত হা/৪৬৯৮।

দাস-দাসীদের নিকটে কখনোই অহংকার প্রকাশ করতেন না। তাদের কোন কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে উহ্ শব্দটি করতেন না। বরং তাদের কাজে নিজে সাহায্য করতেন। 

আনাস (রাঃ) বলেন, আমি ১০ বছর রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমত করেছি। কিন্তু তিনি কখনো আমাকে কোন কাজের জন্য কৈফিয়ত তলব করেননি।[21]. বুখারী হা/৬০৩৮; মুসলিম হা/২৩০৯; মিশকাত হা/৫৮০১।

অবশ্য তার অর্থ এটা নয় যে, অন্যায় কথা বা কাজের জন্য তিনি কাউকে ধমকাতেন না বা ভৎর্সনা করতেন না। যেমন তিনি উসামা ও খালেদকে ধমকিয়েছেন এবং তাদের ব্যাপারে তিনি দায়ী নন বলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়েছেন।[22]. মুসলিম হা/৯৬; বুখারী হা/৪৩৩৯।

তিনি সর্বদা আগে সালাম দিতেন ও মুছাফাহার জন্য আগে হাত বাড়িয়ে দিতেন। ছাহাবীগণকে সম্মান করে অথবা আদর করে কখনো কখনো তাদের উপনামে ডাকতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন ওছমানকে তার উপনামে ‘আবুবকর’, আব্দুর রহমান বিন ছাখারকে ‘আবু হুরায়রা’ (ছোট বিড়ালের বাপ), আলীকে ‘আবু তোরাব’ (ধূলি ধুসরিত), হুযায়ফাকে ‘নাওমান’ (ঘুম কাতর), অতি সতর্ক ও সাবধানী হওয়ার কারণে আনাসকে ‘যুল উযনাইন’ (দুই কান ওয়ালা), সফরে অধিক বোঝা বহনকারী হিসাবে মুক্তদাস মিহরান বিন ফার্রূখ-কে ‘সাফীনাহ’ (নৌকা) বলে ডাকতেন।[23]

উল্লেখ্য যে, খুশী অবস্থায় উপনামে ডাকা আরবীয় রীতি হিসাবে প্রসিদ্ধ।


(ক) দুগ্ধদায়িনী মা, রোগী, বৃদ্ধ, মুসাফির ইত্যাদি বিবেচনায় তিনি জামা‘আতে ছালাত সংক্ষেপ করতেন।[24]


(খ) রাসূল (ছাঃ)-এর ‘আযবা’ (الْعَضْبَاءُ) নাম্নী একটা উষ্ট্রী ছিল। সে এতই দ্রুতগামী ছিল যে, কোন বাহন তাকে অতিক্রম করতে পারত না। কিন্তু একদিন এক বেদুঈনের সওয়ারী আযবা-কে অতিক্রম করে গেল। বিষয়টি মুসলমানদের কাছে কষ্টদায়ক মনে হ’ল। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,إِنَّ حَقًّا عَلَى اللهِ أَنْ لاَ يَرْفَعَ شَيْئًا مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ وَضَعَهُ ‘দুনিয়াতে আল্লাহর নীতি এটাই যে, কাউকে উঁচু করলে তাকে নীচুও করে থাকেন’।[25]


(গ) জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে خَيْرُ الْبَرِيَّةِ (সৃষ্টির সেরা) বলে সম্বোধন করলে তিনি তাকে বলেন, ذَاكَ إِبْرَاهِيْمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ ‘তিনি হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)’।[26]


(ঘ) একবার এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে এসে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়ে। তখন তিনি তাকে বলেন,هَوِّنْ عَلَيْكَ فَإِنِّىْ لَسْتُ بِمَلِكٍ إِنَّمَا أَنَا ابْنُ امْرَأَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ تَأْكُلُ الْقَدِيْدَ ‘স্থির হও! আমি কোন বাদশাহ নই। আমি একজন কুরায়েশ মহিলার সন্তান মাত্র। যিনি শুকনা মাংস ভক্ষণ করতেন’।[27] উল্লেখ্য যে, আরবের গরীব লোকেরা শুকনা মাংস খেতেন। এ সকল ঘটনায় বাস্তব জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর বিনয় ও নম্রতা অবলম্বনের ও নিরহংকার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।

সংসার জীবনে (فى حياته العائلية) : 

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) নিজের জুতা নিজেই সেলাই করতেন ও কাপড়ে তালি লাগাতেন। নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, সংসারের কাজ নিজ হাতে করতেন, নিজে বকরী দোহন করতেন, কাপড় ছাফ করতেন ও নিজের কাজ নিজে করতেন’।[28]


স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা (রাঃ) ছিলেন কুমারী ও সবচেয়ে কম বয়স্কা। তাই রাসূল (ছাঃ) কখনো কখনো সাথীদের এগিয়ে দিয়ে নিজে তার সাথে দৌড়ে পাল্লা দিতেন। তাতে আয়েশা জিতে যেতেন। আবার আয়েশা ভারী হয়ে গেলে প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে যান’।[29] তাকে নিয়ে বিয়ে বাড়ীতে বেদুঈন মেয়েদের নাচ-গান শুনেছেন।[30] রাসূল (ছাঃ) যে কত বাস্তববাদী ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন, এতে তার প্রমাণ মেলে। খায়বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে নব পরিণীতা স্ত্রী ছাফিইয়াকে উটে সওয়ার করার জন্য তিনি নীচু হয়ে নিজের হাঁটু পেতে দেন। অতঃপর ছাফিইয়াহ নবীর হাঁটুর উপরে পা রেখে উটে সওয়ার হন’।[31]

সমাজ জীবনে (فى حياةه الإجةماعية) : 

বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। নিজের ও স্ত্রী সম্পর্কিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক রক্ষা করতেন। কারু ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ হ’তে দূরে থাকতেন। পরনিন্দা ও পরচর্চা হতে বেঁচে থাকতেন। সঙ্গী-সাথীদের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি শত্রুদের দেওয়া কষ্টে ও মূর্খদের বাড়াবাড়িতে ধৈর্য ধারণ করতেন। তিনি মন্দকে মন্দ বলতেন ও ভালকে ভাল বলতেন। কিন্তু সর্বদা মধ্যপন্থী আচরণ করতেন।[32] তিনি সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতেন। তাঁর নিকটে লোকেদের মর্যাদার ভিত্তি ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতা (আহমাদ হা/২৩৫৩৬)। সমাজের দুর্বল শ্রেণীর প্রতি তাঁর করুণা ছিল সর্বাধিক। তিনি বলতেন,اَبْغُونِىْ فِي الضُّعَفَاءِ فَإِنَّمَا تُرْزَقُوْنَ وَتُنْصَرُوْنَ بِضُعَفَائِكُمْ ‘তোমরা আমাকে দুর্বল শ্রেণীর মধ্যে তালাশ করো। কেননা তোমরা রূযিপ্রাপ্ত হয়ে থাক এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাক দুর্বল শ্রেণীর মাধ্যমে’।[33] অর্থাৎ তাদের প্রতি সদাচরণের মাধ্যমে তোমরা আমার সন্তুষ্টি তালাশ কর।

সমাজ সংস্কারে তিনি জনমতের মূল্যায়ন করতেন। যেমন-

(১) কুরায়েশদের নির্মিত কা‘বাগৃহে ইবরাহীম (আঃ) নির্মিত কা‘বাগৃহ থেকে কিছু অংশ ছেড়ে রাখা হয়েছিল। ছাড়া অংশটিকে ‘রুকনে হাত্বীম’ বলা হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) চেয়েছিলেন ওটাকে ইবরাহীমী ভিতের উপর কা‘বাগৃহের মধ্যে শামিল করতে এবং কা‘বাগৃহের দু’টো দরজা করতে। কিন্তু জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে তিনি তা করেননি। এবিষয়ে তিনি একদিন আয়েশা (রাঃ)-কে বলেন,لَوْلاَ قَوْمُكِ حَدِيْثٌ عَهْدُهُمْ بِكُفْرٍ لَنَقَضْتُ الْكَعْبَةَ فَجَعَلْتُ لَهَا بَابَيْنِ بَابٌ يَدْخُلُ النَّاسُ وَبَابٌ يَخْرُجُوْنَ، ‘যদি তোমার কওম নওমুসলিম না হ’ত, তাহ’লে আমি কা‘বা ভেঙ্গে দিতাম এবং এর দু’টি দরজা করতাম। একটি দিয়ে মুছল্লীরা প্রবেশ করত এবং অন্যটি দিয়ে বেরিয়ে যেত। কিন্তু কুরায়েশরা তা না করে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে। যাতে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (৬৪-৭৩ হি.) সেটি করেন’।[34]

(২) তিনি সাধ্যপক্ষে উম্মতের ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করতেন। যেমন-

মুনাফিকদের অপতৎপরতা সীমা ছাড়িয়ে গেলে ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, আমাকে অনুমতি দিন এই মুনাফিকটাকে (ইবনু উবাইকে) শেষ করে দিই। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, না। তাতে লোকেরা বলবে যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করছেন’।[35]

(৩) তিনি লোকদের সাথে নম্র আচরণ করতেন। বৈঠকে তিনি কোনরূপ অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না। বেদুঈনদের রূঢ় আচরণে তিনি ধৈর্য অবলম্বন করতেন। বলা চলে যে, তাঁর এই বিনয়ী ব্যবহার ও অতুলনীয় ব্যক্তি মাধুর্যের প্রভাবেই রুক্ষ স্বভাবের মরুচারী আরবরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছিল। আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ‘আর আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই অনন্য চরিত্র মাধুর্য ছিল নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিশেষ দান।

[1]. হাকেম হা/৪২২১; ছহীহাহ হা/৪৫, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[2]. মুসলিম হা/৮৬৮ (৪৬); মিশকাত হা/৫৮৬০।

[3]. মুক্বাদ্দামা ফাৎহুল মুলহিম শারহু মুসলিম ১৬ পৃঃ।

[4]. বুখারী হা/৬১১৪; মুসলিম হা/২৬০৯ (১০৭); মিশকাত হা/৫১০৫ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ২০ অনুচ্ছেদ।

[5]. মুসলিম হা/২৩২৮ (৭৯); মিশকাত হা/৫৮১৮।

[6]. আবুদাঊদ হা/১৩১৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৭০৩; মিশকাত হা/১৩২৫।

[7]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ওয়াক্বি‘আহ ৩৫-৩৮ আয়াত; রাযীন, মিশকাত হা/৪৮৮৮, সনদ ছহীহ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘ঠাট্টা করা’ অনুচ্ছেদ।

[8]. তিরমিযী হা/২৫৪৫; আহমাদ হা/২২১৫৯; ছহীহাহ হা/২৯৮৭; মিশকাত হা/৫৬৩৯।

[9]. বুখারী হা/৬২১১; মুসলিম হা/২৩২৩; মিশকাত হা/৪৮০৬।

[10]. বুখারী হা/৬১২৯; মুসলিম হা/২১৫০ (৩০); মিশকাত হা/৪৮৮৪ ‘ঠাট্টা করা’ অনুচ্ছেদ।

[11]. বুখারী হা/৫০৫০; মুসলিম হা/৮০০; মিশকাত হা/২১৯৫।

[12]. বুখারী হা/৬০৮৮; মুসলিম হা/১০৫৭; মিশকাত হা/৫৮০৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।

[13]. আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।

[14]. বুখারী হা/৬১২৬; মুসলিম হা/২৩২৭; মিশকাত হা/৫৮১৭ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ।

[15]. বুখারী হা/৬৪১১; মুসলিম হা/২৮২১; মিশকাত হা/২০৭।

[16]. বুখারী হা/১৯৬৬ ‘ছওম’ অধ্যায়-৩০ ‘ছওমে বেছালে বাড়াবাড়ির শাস্তি’ অনুচ্ছেদ-৪৯।

[17]. বুখারী হা/১৩; মুসলিম হা/৪৫ (৭২); মিশকাত হা/৪৯৬১ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ।

[18]. তিরমিযী হা/১৬৩৩; নাসাঈ হা/৩১০৮; মিশকাত হা/৩৮২৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[19]. বুখারী হা/৬১০২; মুসলিম হা/২৩২০; মিশকাত হা/৫৮১৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ।

[20]. তিরমিযী হা/২৭৫৪; মিশকাত হা/৪৬৯৮।

[21]. বুখারী হা/৬০৩৮; মুসলিম হা/২৩০৯; মিশকাত হা/৫৮০১।

[22]. মুসলিম হা/৯৬; বুখারী হা/৪৩৩৯।

[23]. আবু হুরায়রা (তিরমিযী হা/৩৮৪০); আবু তোরাব (বুখারী হা/৬২০৪); নাওমান (মুসলিম হা/১৭৮৮ (৯৯); যুল-উযনাইন (আবুদাঊদ হা/৫০০২; তিরমিযী হা/১৯৯২; মিশকাত হা/৪৮৮৭); সাফীনাহ (আহমাদ হা/২১৯৭৮, সনদ হাসান; হাদীছের প্রথমাংশ মিশকাত হা/৫৩৯৫)।

[24]. বুখারী হা/৭০৩; মুসলিম হা/৪৬৭ (১৮৩); মিশকাত হা/১১৩১, ৩৪, ২৯।

[25]. বুখারী হা/৬৫০১ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়-৮১ ‘নম্রতা’ অনুচ্ছেদ-৩৮।

[26]. মুসলিম হা/২৩৬৯; মিশকাত হা/৪৮৯৬ ‘শিষ্টাচারসমূহ’ অধ্যায় ১৩ অনুচ্ছেদ।

[27]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩১২; ছহীহাহ হা/১৮৭৬।

[28]. আহমাদ হা/২৬২৩৭; মিশকাত হা/৫৮২২ সনদ ছহীহ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।

[29]. ইবনু মাজাহ হা/১৯৭৯; ছহীহাহ হা/১৩১।

[30]. বুখারী হা/৫১৯০; মুসলিম হা/৮৯২ (১৮); মিশকাত হা/৩২৪৪; বুখারী হা/৫১৪৭; মিশকাত হা/৩১৪০।

[31]. বুখারী হা/৪২১১ ‘খায়বর যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ ।

[32]. বুখারী হা/৩৯; মিশকাত হা/১২৪৬।

[33]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৫২৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৭৯।

[34]. বুখারী হা/১২৬ ‘ইলম’ অধ্যায়-৩, অনুচ্ছেদ-৪৮; ঐ, হা/১৫৮৪ ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৪২।

[35]. তিরমিযী হা/৩৩১৫ সনদ ছহীহ ।

No comments

Powered by Blogger.